বিশেষ প্রতিবেদন
মোহাম্মদ জাফর ইকবাল
২২ জানুয়ারি ২০২৫
কবির ভাষায়, ‘ এ-কূল ভাঙে, ও-কূল গড়ে, এই তো নদীর খেলা’। নদী বারবার গতিপথ বদলায়, আকৃতি পরিবর্তন করে। বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান নদী পদ্মা। গত ৩০ বছরে পদ্মা নদীর ভূমিরূপ বারবার বদলেছে, নদীর আকৃতি ও গড়নে এসেছে ভিন্ন-ভিন্ন পরিবর্তন। আর বহুরূপী এ চরিত্রের কারণে পদ্মা কখনো কারও জন্য হয়ে উঠেছে আশীর্বাদ, কারও কাছে অভিশাপ। এবার সেই অভিশাপের শিকার হচ্ছে ঢাকা ওয়াসা। নদীর গতিপথ পরিবর্তনের কারণে পদ্মা পানি শোধনাগার বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড এর মহাপরিচালক বরাবর ঢাকা ওয়াসা ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো: ফজলুর রহমান সাক্ষরিত এক চিঠিতে (স্মারক নং ৪৬.১১৩.৬২৮.০০০০০১.২৪-৩২২) এ তথ্য উঠে আসে। এতে বলা হয়েছে, পদ্মা নদী পরিবর্তনের কারণে ঢাকা মাহনগরীতে দুই কোটি মানুষের জন্য পানি সরবরাহকারী পদ্মা পানি শোধনাগারটি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। অবিলম্বে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথা চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।
সূত্র মতে, গত বছরের ৩ নভেম্বর বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক বরাবর একটি চিঠি পাঠান ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো: ফজলুর রহমান। চিঠিতে বলা হয়, দৈনিক ৪৫ কোটি লিটার পানি উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন পদ্মা পানি শোধনাগার ঢাকা ওয়াসার তথা দেশের বৃহত্তম পানি শোধনাগার এবং একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। যশলদিয়া লৌহজং মুন্সীগঞ্জে অবস্থিত এই শোধনাগারে পরিশোধিত পানি ২০০০ মিমি ব্যাসের প্রায় ৩৩ কি: মি: দীর্ঘ ট্রান্সমিশন পাইপলাইনের মাধ্যমে ঢাকা মহানগরে সরবরাহ করা হয়। যা নগরীর দক্ষিণ ও দক্ষিণ পেিশ্চম অংশে বসবাসকারী প্রায় ৪০ লক্ষাধিক লোকের সুপেয় পানির চাহিদা মিটিয়ে থাকে। ঢাকা ওয়াসার পারি সরবরাহ মাহপরিকল্পনা অনুযায়ী একই স্থানে আরও একটি ৪৫ কোটি লেটার ক্ষমতাসম্পন্ন পানি শোধনাগার নির্মাণ করা হবে। ফলে ঢাকা শহরের পানি সরবরাহ ব্যবস্থা ভূগর্ভস্থ উৎসের পরিবর্তে ভূ-উপরিস্থ উৎস কেন্দ্রীক ব্যবস্থাপনায় রূপান্তরিত হবে।
চিঠিতে আরও বলা হয়, ঢাকা ওয়াসার পারি সরবরাহ মহাপরিকল্পনা হালনাগাদকরণের অংশ হিসেবে ইন্সটিটিউট অফ ওয়ার্টার মডেলিং কর্তৃক পরিচালিত সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, পদ্মা সেতুর প্রভাবে নদীর প্রধান প্রবাহ চ্যানেলটি দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে এবং যশলদিয়াস্থ ইনটেক পয়েন্টের সম্মুখস্থ পূর্বের চর ও নতুন সৃষ্ট চর মিলেমিশে নদীর পূর্ব তীর সংলগ্ন চ্যানেল মারাত্বকভাবে সংকুচিত হয়ে পড়েছে। এরুপ পরিস্থিতিতে পানি শোধনাগারের ইনটেক চ্যানেল সংলগ্ন চ্যানেলিটি অচিরেই স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে। ফলে পদ্মা পানি শোধনাগার বন্ধ হবার হুমকির সম্মুখীন। ঢাকা মহানগরে বসবাসকারী ২ কোটির অধিক জনসাধারণের জন্য সুপেয় পানি সরবরাহ নিরবিছিন্ন রাখার স্বার্থে পদ্মা পানি শোধনাগার ফেজ-১ চালু রাখা এবং ফেজ-২ নির্মাণ করা অত্যাবশ্যক। এমতবস্থায় ঢাকা ওয়াসার পদ্মা পানি শোধনাগার এর ইনটেক পয়েন্টে নিরবিচ্ছিন্ন পানি প্রাপ্তি বজায় রাখার স্বার্থে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করা হয় উক্ত চিঠিতে। একইসাথে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে দ্রুত একটি দ্বিপাক্ষিক সভাও করার উপর তাগিদ দেয়া হয়।
জানা গেছে, চিঠি দেয়ার প্রায় আড়াই মাস অতিবাহিত হলেও কোনো ধরণের দ্বিপাক্ষিক সভা আয়োজস করতে পারেনি পানি উন্নযন বোর্ড। ওয়াসার পক্ষ থেকে বারবার তাগাদা দিলেও পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্টরা অন্য কাজে ব্যস্ত আছেন, এই অজুহাতে মিটিং আহবান করতে পারছেন না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে যশলদিয়া পানি শোধনাগারের নির্বাহী পরিচালক গাজী আসরিব বিন সালাম বলেন, মিটিং এখনো হয়নি। গত মঙ্গলবারও এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাথে কথা হয়েছে বলে তিনি জানান। কি কারণে মিটিং হচ্ছে না জানতে চাইলে তিনি বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্টরা অন্য কাজে ব্যস্ত থাকায় সময় দিতে পারছেন না। তিনি বলেন, আশা করি মিটিং শীঘ্রই হবে। কবে নাগাদ হতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগামী সপ্তাহে হবার সম্ভাবনা বেশি। তিনি বলেন, বিষয়টি সরাসরি ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তদারকি করছেন। সংশ্লিষ্ট সবার সাথে তিনি যোগাযোগ রাখছেন।
জানাে গেছে, পদ্মার ভাঙনে নিয়মিত বিলুপ্ত হয় এর পাড়ে থাকা স্থাপনা, বসতি ইত্যাদি। ১৯৬৭ সালের পর থেকে ৬৬ হাজার হেক্টরের বেশি পরিমাণ জমি পদ্মার বুকে বিলীন হয়েছে। এর মধ্যে গত ৩০ বছরে পদ্মা নদীর ভূমিরূপ বারবার বদলেছে, নদীর আকৃতি ও গড়নে এসেছে ভিন্ন-ভিন্ন পরিবর্তন। এই পরিবর্তনে পদ্মা কখনো কারও জন্য হয়ে উঠেছে আশীর্বাদ, কারও কাছে অভিশাপ। পদ্মা নদী বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান জলপথ। এর পানি চাষাবাদের কাজে ব্যবহার করেন কৃষকেরা। নদীর দীর্ঘ ১৩০ কিলোমিটার তটরেখায় বাস করা মানুষগুলোকে নদীর খেয়ালের সঙ্গে প্রতিনিয়ত মানিয়ে চলতে হয়। পদ্মার ভাঙনে নিয়মিত বিলুপ্ত হয় এর পাড়ে থাকা স্থাপনা, বসতি ইত্যাদি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পদ্মার এ তীব্র ভাঙনের পেছনে দুটো প্রধান কারণ রয়েছে। প্রথমত, পদ্মা একটি প্রাকৃতিক নদী- এর গতি অবাধ, কিন্তু এর কূল রক্ষায় বিশেষ কোনো ব্যবস্থা নেই। কেবল মাঝেমধ্যে কিছু বালুর বস্তা ফেলে পদ্মার ভাঙন রোধের চেষ্টা করা হয়। দ্বিতীয় কারণটি হলো, পদ্মার পাড় একটি বড় বালুতটের ওপর অবস্থিত, ফলে খুব দ্রুতই এটি ক্ষয়ে যায়। বিজ্ঞানীরা পদ্মার প্রশস্ততা, গভীরতা, গড়ন, ও সার্বিক রূপ পর্যবেক্ষণ করে এটির ক্ষয়ের পরিমাণ নির্ধারণ করেছেন। স্যাটেলাইট ইমেজে ধরা পড়েছে ১৯৮৮ সালের পর থেকে পদ্মার আকৃতিতে কী ধরনের পরিবর্তন এসেছে। এতে দেখা য়ায়, পদ্মা একটি আঁকাবাঁকা নদী, এর প্রবাহ সর্পিল। এ ধরনের নদীর ক্ষেত্রে বাইরের কিনারা আস্তে আস্তে ক্ষয়ে যায় বলে নদীর চ্যানেল প্রশস্ত হয়। অন্যদিকে ভেতরের কিনারায় স্রোতের শক্তি কম থাকে, ফলে নদীতে পলি জমে। সর্পিল নদীগুলো মাঝেমধ্যে স্থান ও গতি পরিবর্তন করে।
সূত্র মতে, ২০১৪ সালে প্রতিদিন ৪৫ কোটি লিটার উৎপাদন ক্ষমতার ‘পদ্মা-জশলদিয়া পানি শোধনাগার’ উদ্ভোধন করা হয়। এটি বাস্তবায়নে ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। প্রথম থেকেই পদ্মা নদীর যে অংশ থেকে পানি নেওয়া হবে, সেখানেও রক্ষা বাঁধে ফাটল দেখা দিয়েছিল। ২০২২ সালের শেষের দিকে প্রকল্পটির কাজ শেষ হয়। অভিযোগ উঠেছে প্রকল্পের পুরো কাজ শেষ না করেই ঢাকা ওয়াসা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে প্রকল্পটি তড়িঘড়ি উদ্বোধন করায়। কারণ এই প্রকল্পের কয়েক দফা মেয়াদ বাড়ানোর শেষ দিকে আর মেয়াদ বাড়ানোর সুযোগ ছিল না বলে প্রকল্পটির উদ্বোধন করা হয়েছে। এতে পানি প্রবাহসহ অনেক কিছুই বিবেচনায় আনা হয়নি।
বিশেষজ্ঞরা জানান, নদীর গতিপথ আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনতে হলে ড্রেজিং করে নদীর গভীরতা বাড়াতে হবে, চরাঞ্চলের ভাঙন রোধে নির্মাণ করতে হবে নদীর তীর সংরক্ষণ বাঁধ।
জানা গেছে, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সঙ্গে যুক্ত ১৬টি ইউনিয়নের ৩৬টি ওয়ার্ডে পদ্মা নদীর পানি সরবরাহ করে ওয়াসা। প্রতিদিন ৪৫ কোটি লিটার বিশুদ্ধ খাবার পানি ৩৫ লাখ মানুষের মাঝে সরবরাহ করা হচ্ছে। তবে নদীন গতিপথ পরিবর্তনের ফলে এটি বাধাগ্রস্থ হতে পারে।
সার্বিক বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো: ফজলুর রহমান বলেন, পদ্মা নদীর গতিপথ পরিবর্তনের বিষয়টি আমরা সিরিয়াসলি নিয়েছি। আমরা পানি উন্নয়ন বোর্ডকে চিঠি দিয়েছি। তিনি বলেন, পানি সরবরাহ যাতে স্বাভাবিক থাকে সে বিষয়ে আমরা সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলছি। খুব শীঘ্রই আলোচনার মাধ্যমে আমরা একটি সমাধানে যেতে পারবো।
জা ই / এনজি