রাত ১:২৪ | বৃহস্পতিবার | ১লা মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১৮ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, গ্রীষ্মকাল | ২রা জিলকদ, ১৪৪৬ হিজরি

দেশের রপ্তানি আয় ১৪ বিলিয়ন ডলার বাড়িয়ে দেখানোর নেপথ্যে

এনজি ডেস্ক
০৯ জুলাই ২০২৪

 

বাংলাদেশে রপ্তানি বাৎসরিক হিসেবে প্রকৃত পরিমাণের চেয়ে ১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বেশি দেখানোর ঘটনা বিভিন্ন মহলে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। রপ্তানির মতো গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর একটি খাতকে নিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানের ভুল তথ্য প্রকাশের এমন ঘটনায় একই সঙ্গে বিস্ময় ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদরা। মঙ্গলবার (৯ জুলাই) বিষয়টি নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করেছে বিবিসি বাংলা।

প্রতিবেদনে বলা হয়, মূলত একটি দেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি থেকে শুরু করে অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক নির্ধারণ এবং অর্থনৈতিক নানান নীতি ও পরিকল্পনা প্রণয়নে রপ্তানি আয়ের প্রকৃত হিসাব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।

কিন্তু রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম দশ মাসের রপ্তানি আয়ের হিসেবে বড় ধরনের অসামাঞ্জস্য ধরা পড়েছে।

ফলে দেশটির জিডিপি, মোট জাতীয় উৎপাদন (জিএনপি), বিদেশি বিনিয়োগ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, ঋণ গ্রহণের নীতি লেনদেনের ভারসাম্য-সহ অর্থনীতির অনেক সূচক এবং নীতির যথার্থতা নিয়েও এখন প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেছেন, সব মিলিয়ে এটি দেশের ভাবমূর্তিকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দিয়েছে। কাজেই কীভাবে এমন একটি ঘটনা ঘটলো, সেটি গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।

কীভাবে ঘটল এত বড় ভুল?

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) অসামাঞ্জস্যপূর্ণ তথ্য নিয়ে সমালোচনার মধ্যেই জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে রপ্তানির প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

সেখানে দেখা গেছে যে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশের প্রকৃত রপ্তানি ইপিবির দেওয়া তথ্যের চেয়ে প্রায় ১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার কম ছিল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক এমন তথ্য প্রকাশের পরে ইপিবিও তাদের রপ্তানির তথ্য সংশোধন করেছে।
কিন্তু রপ্তানি বেশি দেখানোর ঘটনাটি কীভাবে ঘটেছে, ইপিবির পক্ষ থেকে সে বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও বক্তব্য জানানো হয়নি।
তবে বিষয়টিকে একটি ‘ভুল’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান।
তার মতে, রপ্তানিযোগ্য একই পণ্যের মূল্য দুইবার ধরে হিসেব করার কারণেই তথ্যে অসামাঞ্জস্য দেখা দিয়েছে।
তিনি বলেন, ইপিবির যেটা ভুল হয়েছে, ইপিজেড থেকে যে রপ্তানি হয়, তা একবার হিসাবে ধরা হয়। আবার যখন গার্মেন্টস থেকে রপ্তানি হয়, সেটা আবার ধরা হয়। এখানে ডাবল হিসাব হয়।
ডলার সংকটের কারণে গত কয়েক বছর ধরেই দেশের লেনদেনের আর্থিক হিসেবে ঘাটতি দেখা যাচ্ছিলো।
সম্প্রতি ঘাটতি আরও বাড়তে থাকায় রপ্তানির প্রকৃত অবস্থা জানতে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো এবং রাজস্ব বোর্ডের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত বছরের সেপ্টেম্বরে কমিটির সদস্যরা রপ্তানির তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাই শুরু করে।
সেটারই সূত্র ধরে শেষমেশ রপ্তানির তথ্যে বড় অসামাঞ্জস্য থাকার বিষয়টি সামনে আসে।

ইপিবির তথ্যে বলা হয়, গত অর্থবছরের দশ মাসে দেশে পণ্য রপ্তানি হয়েছে মোট ৪৭ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেবে দেখা যাচ্ছে, ওই একই সময়ে রপ্তানি আয় এসেছে মাত্র ৩৩ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

দায় কার?
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর প্রতিবেদনে তথ্যের বড় ধরনের যে অসামাঞ্জস্যতা দেখা যাচ্ছে, সেটির দায় প্রতিষ্ঠানটি সরাসরি স্বীকার করছে না।
কর্মকর্তরা দাবি করেছেন যে, এনবিআরের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই তারা রপ্তানির তথ্য প্রকাশ করেছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বিবিসি বাংলাকে বলেন, এটি আমাদের ভুল, সেটি বলা যাবে না। তবে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে রাজস্ব বোর্ড এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে ইপিবি যৌথভাবে কাজ করছে। আমরা একসঙ্গে বসছি এবং সমস্যার মূলটা খুঁজে বের করে সমাধানের চেষ্টা করছি।
রপ্তানি পণ্যের মূল্য এবং তার বিপরীতে দেশে আসা রপ্তানি আয়ের ব্যবধান বাংলাদেশে অনেকদিন থেকেই বাড়তে দেখা যাচ্ছিলো।
ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকেও অতীতে বিভিন্ন সময়ে এ বিষয়ে অভিযোগ জানানো হয়েছে।

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বিবিসি বাংলাকে বলেন, ২০২২ সাল থেকেই আমরা বলছি যে, ইপিবির রপ্তানি তথ্যে ভুল আছে। কিন্তু আমাদের কথা সেভাবে আমলে নেওয়া হয়নি। করোনা মহামারির কারণে রপ্তানি কমে যাওয়ায় বিষয়টি প্রথমে নজরে আসে।

তিনি বলেন, করোনার মধ্যে আমাদের ব্যবসা খুব একটা ভালো ছিল না। কিন্তু ২০২২ সালের নভেম্বরে দেখা গেলো যে, ইপিবি পাঁচ বিলিয়নের রপ্তানি দেখিয়েছে। তখনই প্রতিবাদ করে বলেছিলাম, এই রপ্তানি আমরা করি নাই।
একই অভিযোগ জানিয়েছে ব্যবসায়ীদের সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি-ও (এফবিসিসিআই)।
এফবিসিসিআই-র সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, আমাদের যেখানে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক হয়, সেখানে ইপিবি দেখায় ইতিবাচক। এটি ইপিবি কীভাবে করে, তা আমাদের জানা নে।
কিন্তু তারপরও কেন বিষয়টি আমলে নেওয়া হল না?
বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, হয়তো তারা সরকারকে খুশি করার জন্য বেশি রপ্তানি দেখাতে চেয়েছে, কিংবা অন্য কোনও গ্রুপের স্বার্থেও এই কাজ করে থাকতে পারে।

যে প্রভাব পড়তে পারে
বিশ্লেষকরা বলছেন, অনেক দিন ধরেই বিদেশি বিনিয়োগকারী থেকে শুরু করে বিভিন্ন সংস্থা ও গবেষকেরা বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে সরকারি বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত নিয়ে সন্দেহ পোষণ করে আসছিলেন।
ফলে রপ্তানির তথ্যে গরমিলের যে ঘটনাটি এখন সামনে এসেছে, সেটি দেশের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নের মুখে ফেলতে পারে।
একই সঙ্গে, রপ্তানির ক্ষেত্রে ভুল তথ্য প্রকাশের কারণে অর্থনীতির সূচকগুলোর গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে পড়েছে বলেও মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

সিপিডি-র নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, যেহেতু জিডিপি-সহ অর্থনীতির অনেকগুলো সূচক নির্ধারণে রপ্তানি আয়ের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়, কাজেই সেগুলো নিয়ে এখন প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক নয়।

এমন অবস্থায় জিডিপি, জিএনপি, লেনদেনের ভারসাম্য, বিদেশি ঋণ গ্রহণের নীতি-সহ অর্থনীতির অনেক সূচক সংশোধন করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

বাংলাদেশের পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলছেনে, বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে বোঝা যাচ্ছে যে, এসব সূচকগুলো ভুল তথ্যের উপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করা হয়েছিল। ফলে সেগুলো দিয়ে অর্থনীতির প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাবে না।

অন্যদিকে, রপ্তানির ভুল তথ্য প্রকাশের কারণে বৈদেশিক বিনিয়োগ এবং রিজার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ।

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, সরকারি তথ্য বা পরিসংখ্যানে বিশ্বাসযোগ্যতার ঘাটতি দেখা দিলে সেটি দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত করতে পারে। কারণ বিনিয়োগকারীরা অর্থ বিনিয়োগের আগে এসব তথ্য বিবেচনায় নেন।
আর সে কারণে কীভাবে তথ্যের গরমিলের ঘটনাটি ঘটল, সেটি খতিয়ে দেখা জরুরি বলেও মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
পিআরআইয়ের পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, কারা এটি করল? কেন করল? এটি নিছকই পদ্ধতিগত ভুল, নাকি তার চেয়ে বেশি কিছু? সেটা দেখা জরুরি।
তিনি বলেন, এর আড়ালে কেউ বাড়তি সুবিধা বা প্রণোদনা নিয়েছে কি না, বা টাকা পাচার করেছে কি না, সেটি খতিয়ে দেখাটাও প্রয়োজন।

জা ই/ এনজি

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *