রাত ১০:২২ | বুধবার | ৩০শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১৭ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, গ্রীষ্মকাল | ১লা জিলকদ, ১৪৪৬ হিজরি

এমডি ও তার সহযোগিদের দুর্নীতি-অনিয়ম ও স্বেচ্চাচারিতায় ডুবতে বসছে সম্ভাবনাময় কমিউনিটি ব্যাংক বাংলাদেশ

বিশেষ প্রতিবেদন

 

ফারহানা আক্তার

০৪ সেপ্টম্বর ২০২৪

 

অনিয়ম, দূর্নীতি আর  স্বেচ্চাচারিতায় ডুবতে বসেছে কমিউনিটি ব্যাংক বাংলাদেশ। এমন তথ্য উঠে এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে। দুই বছর আগে নানা অভিযোগের ব্যাখ্যা দিতে ব্যাংকটিকে আদেশ দেয়া হলেও এখন পর্যন্ত সেগুলোর কোনো যথাযথ জবাব দেয়া হয়নি বলে জানা গেছে। ব্যাংকটিতে কর্মরতরা বলছেন, দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ প্রাপ্ত কমিউনিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মাশিউল হক চৌধুরী ও তার গংদের অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার কারণে প্রতিষ্ঠানটি এখন ডুবতে বসেছে। ফের তৃতীয়বার চুক্তি নবায়নে মরিয়া বহুল সমালোচিত বর্তমান এমডিসহ তার অনুসারীরা। আগামীকাল (০৫ সেপ্টম্বর) বৃহস্পতিবার ব্যাংকের বোর্ড সভায় এসব নিয়ে সিদ্ধান্ত হতে পারে বলে জানা গেছে।

সূত্র জানায়,  ব্যাংকটির পাহাড়সম অভিযোগের নানা অনিয়মের ব্যাখ্যা চেয়ে ২০২২ সালে চিঠি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই রিপোর্ট পাবলিশ হয় ১৭ ডিসেম্বর ২০২৩ সালে। আর রিপোর্ট পেশ হয় ৯মে ২০২৪ সালে। অভিযোগ রয়েছে, দীর্ঘ প্রায় দুইবছরেও দলের প্রভাব দেখিয়ে ব্যাংকটির কর্মকর্তারা সেগুলোর সঠিক কারণ জানানোর প্রয়োজনও বোধ করেনি। বছরের পর বছর ব্যাংকে ঘটে যাওয়া অনিয়ম ও দুর্নীতির সাথে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেয়ার ফলশ্রুতিতে পুলিশের কষ্টে অর্জিত বেতনের টাকায় প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকটি নিভু নিভু করে জ¦লছে। অভিযোগ উঠেছে।

এদিকে বৈষম্য, অনিয়ম, দুর্নীতির হাত থেকে ব্যাংকটিকে বাঁচানোর আকুল আবেদন জানিয়ে সম্প্রতি আইজিপি বরাবর চিঠি দিয়েছে প্রতিষ্ঠানের সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও। তারা বলেছে, পুলিশের কষ্টে অর্জিত বেতনের টাকায় প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকটিতে একজন সৎ, নিষ্ঠাবান ও দক্ষ এমডি নিয়োগ এবং অনিয়ম দুর্নীতির সাথে জড়িত বিতর্কিত সকল কর্মকর্তাদের অপসারণপূর্বক বিচার করতে হবে। অন্যথায় ব্যাংটিকে টিকানো কোনভাবেই সম্ভব হবেনা।

অভিযোগে প্রকাশ, কমিউিনিটি ব্যাংকের এমডি আওয়ামী লীগের কট্টর সমর্থক। তিনিসহ তার শুশুর পরিবার পুরোটাই আওয়ামী রাজনীতির সাথে জড়িত। জানা গেছে, একাত্তর টিভির মালিক বিতর্কিত মোজাম্মেল বাবু উনার আপন ভায়রা, এছাড়া তিনি বিগত ফ্যাসিস্ট আওয়ামীলীগ এর মহিলা কোটার এমপি অপরাজিতা হকের বোন জামাই। উনার শ্বশুর আওয়ামীলীগ নেতা টাংগাইলের সাবেক এমপি মরহুম আসাদুজ্জামান। উনার বাবা সুপ্রিমকোর্ট বারের হয়ে ৫ বার নির্বাচিত সাবেক আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন।

সূত্র জানায়, ⁠বিতর্কিত সাবেক আইজিপি বেনজিরের আমলে ব্যাংকের স্বার্থ বহির্ভূত অনেক সিদ্ধান্ত তিনি গ্রহন করেছেন। যার ফলে ব্যাংকটিকে আর্থিক বিড়ম্বনা পোহাতে হচ্ছে। গোপালগঞ্জে অবস্থিত বেনজিরের সাভানা রিসোর্ট এ নিত্য যাতায়াত ছিল ব্যাংকের এমডি, সিএফও এবং তাদের সহযোগীদের। এই রিসোর্টের ভ্যালুয়েশন করতে এমডি সহযোগিতা করেন। যার মাধ্যমে উক্ত রিসোর্ট এর জন্য ব্যাংক হতে মোটা অঙ্কের লোন অতি সহজে বের করে ফেলেন তারা। এই প্রক্রিয়াতে তথা অর্থিক প্রতিবেদন তৈরীতে কমিউনিটি ব্যাংকের সিএফও কে ব্যাবহার করা হয়েছে, যা নিয়ম বহিঃভূত।

জানা গেছে, ২০২১ এ সালমান এফ রাহমান এর বেক্সিমকো গ্রুপের ২০ কোটি টাকার গ্রিন সুকুক বন্ড অতি রিস্কি জেনেও কেনা হয় ট্রেজারি হেড নবদিপ এর মাধ্যমে। যেখানে ব্রাক ব্যাংকের এমডি সে সময় কোন চাপের নিচে নতজানু না হয়ে এমন ঋণ খেলাপি কোম্পানিতে বিনিয়োগ হতে তার ব্যাংকে বিরত রাখে, সেখানে একটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাংক হয়েও এমন বাজে বিনিয়োগ করেছেন এমডি। বর্তমানে এই ২০ কোটির সুকুক বন্ড এর মূল্য ১০ কোটির নিচে বলে জানা গেছে।

ব্যাংকটিতে কর্মরতরা জানান, পরপর দুই মেয়াদে দীর্ঘ সাত (৭) বছর একচ্ছত্র আধিপত্য বিরাজ করে ব্যাংকে বৈষম্যমূলক পদোন্নতি, নিয়োগ ও দায়িত্ববণ্টন একটি নিয়মিত ব্যাপারে পরিণত করেছেন বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক। বোর্ডকে না জানিয়ে যাকে খুশি তাকে গোপনে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক তার বিগত প্রতিবেদনে তা স্পষ্ট করেছে। যা ২০২৪ এর মে মাসে পুলিশ হেডকোয়ার্টারে অনুষ্ঠিত ব্যাংক এর বোর্ড মিটিং এ তৎকালীন অ্যাইজিপি ও সমস্ত পরিচালকের সামনে উপস্থাপন করা হয়। এ বিষয়ে এখনো দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, মানবসম্পদ বিভাগের হেড কানিজ ফাতেমাকে কোন ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা ছাড়া নিয়োগের মাত্র ৬ মাস ১৯ দিনের মাথায় ফের পদোন্নতি দেওয়া হয়। এতে বলা হয়েছে, এইচআর হেড একটি কর্মী বান্ধব কর্ম পরিবেশ সৃষ্টিতে সব দিক দিয়ে ব্যর্থতা সত্বেও পদোন্নতি ও দাপটের সাথে কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়া কর্পোরেট ব্রাঞ্চ ম্যানেজারকে (এস কে জালাল) আলাদা ভাবে তিন বছরে তিন বার পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এইভাবে যথাযথ নিয়ম না মেনে বারবার পদোন্নতি দেয়া হয়েছে উনার পিএস নাজিয়া, ট্রেজারি হেড নব দিপ, সিএমও, জিএসডি হেড সহ আরও অনেককে। এছাড়া কোন রকমের প্রশিক্ষণ বা তদারকি ছাড়া বিভিন্ন অজুহাতে অনেক ব্রাঞ্চ ম্যানেজার ও অন্যান্য যোগ্য কর্মকর্তাদেরকে চাকুরীচ্যুত করা হয়, যার নেপথ্যে সিএমও ইয়াসির নুর রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। জানা গেছে, এই ইয়াসির নুর ওয়ার্ল্ড কাপ চলাকালীন সময় নায়িকা পরিমনি আর দিঘিকে নিয়ে ব্যাংক এর অফিসিয়াল পেজ এ পোস্ট দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির ভাবমূর্তি খুন্ন করেছিলেন। এই সব বিষয়ে প্রতিবাদ জানানোর কারণে ব্যাংকের অনেক বিশ্বস্ত এবং অভিজ্ঞতাসম্মন্ন কর্মীদের বছরের পর বছর পদোন্নতি বঞ্ছিত ও কাজ হতে সরিয়ে রাখা হয়েছে।

আইজিপি বরাবর কর্মরতদের দেয়া আবেদন থেকে জানা যায়, অন্যান্য ব্যাংকের ন্যায় কমিউিনিটি ব্যাংকে এখনও কোন কর্মী (অগাস্ট) তাদের বাৎসরিক মূল্যস্ফীতি সমন্বয় পূর্বক বর্ধিত বেতন বা বাৎসরিক মুনাফা পায়নি। অথচ যথা সময়ে এমডি তার বাৎসরিক বর্ধিত বেতন ও ব্যাংক হতে প্রাপ্ত অন্যান্য সুবিধা সমূহ প্রতি বছর জানুয়ারী মাস হতে বুঝে নিয়েছেন।
এই আবেদনে আরও বলা হয়, ব্যাংকের আমানত ও ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্যতা ছিল লক্ষ্যনীয়। বিতর্কিত কিছু কোম্পানি যেমন মেঘনা ফ্রেশ, নগদ, রঙধনু, বৈশাখী রাইস মিল (বগুড়া), এনার্জি পেক (যাকে কোন ব্যাংক ঋণ দেয় না) তাদেরকে বিশেষ সুবিধা প্রদান করা হয়েছে। মেঘনা ফ্রেশ এবং নগদকে অন্য যেকোনো কারোর থেকে বেশি রেটে আমানত এর উপর মুনাফা দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন এর সদ্য প্রাক্তন চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত ও তার এক সময়ের ছাত্রী বর্তমানে ব্যাংকের ক্রেডিট রিস্ক ম্যানেজমেন্ট বিভাগের প্রধান হাসি রানী বেপারীর যোগসাজশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রমাণিত। পুলিশ বাহিনীর অগাধ বিশ্বাস এবং ব্যস্ততাকে পুঁজি করে এমন কিছু প্রতিষ্ঠানকে ঋণ সুবিধা দেওয়া হয়েছে যাদের মার্কেট এ অন্য কোন ব্যাংক ঋণ দিতে চাইবে না। এর মধ্যে রংধনু গ্রুপ অন্যতম।

অভিযোগ থেকে জানা গেছে, এমডি তার পছন্দমত পদোন্নতি প্রদান করতেন। নবনিজুক্ত জেনারেল সার্ভিস ডিভিশনের (জিএসডি) হেড কে ২০২৩ সালে স্পেশাল প্রমোশন দেয়া হয়েছে এক বছরের কম সময়ে। জিএসডি ও প্রকিউরমেন্ট ডিভিশনে গত ছয় মাসে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে ৩ জনকে তাপসের মধুমতি ব্যাংক থেকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যেখানে পূর্বে থেকে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন কর্মকর্তারা নিয়জিত ছিল। করোনা পরবর্তী ২ বছর ধরে কোন ব্রাঞ্চ বা ব্যাংক এর স্থাবর কার্যক্রম ছিল না, সেখানে কেন নতুন করে এত জনবল এই ডিভিশনে নেওয়া হল তা খতিয়ে দেখা দরকার বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। কেনাকাটার সাথে জড়িত এমন স্পর্শকাতর ডিভিশনে বোর্ডকে ঠিক মত অবগত না করে একই প্রতিষ্ঠান হতে একাধিক কর্মী (হেডসহ) নিয়োগ একটি সন্দেহজনক এবং বিরল ঘটনা বলে কর্মরতরা জানান।

জানা গেছে, ব্যাংকের একটি বিরাট অংশ চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মাধ্যমে ৫ বছরের অধিক সময় ধরে সেবা দিয়ে আসছে সকল গ্রাহক ও পুলিশ সদস্যদের। এই কাস্টমার সার্ভিস এক্সিকিউটিভ (সিএসসি) মাঠ পর্যায়ের পুলিশ বাহিনিকে ৬৪ জেলাতে যাবতীয় ব্যাংকিং সার্ভিস, এটিএম রক্ষণাবেক্ষণ, ক্রেডিট কার্ড ও ঋণ বিষয়ক যাবতীয় সেবা দিয়ে আসছে সব সময়। তাদের এই অক্লান্ত পরিশ্রমকে সব সময় ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট পাস কাটিয়ে গিয়েছেন। বর্তমানে একজন অনভিজ্ঞ কিন্তু এমডির অতি কাছের কর্মকর্তা সিএমও কে দিয়ে স্বেচ্চাচারি ও দমন নিপীড়ন এর মাধ্যমে সার্ভিস ডেস্ক ও কল সেন্টার এর মতন অতি জরুরী ব্যাংকিং সেবা চালানো হচ্ছে। অন্যদিকে, এমডির বৈষম্যমূলক নিয়োগ ও পদোন্নতি নীতিতে ব্যাংক এর সকল কর্মকর্তাদের মাঝে একটি হতাশা ও অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। এই সকল কর্ম চঞ্চল কর্মীদের (চুক্তিভিত্তিক) কে সামান্য চাকরির নিরাপত্তা তথা নিয়োগ স্থায়ী করার কথা থাকলেও সেটি করেননি এমডি ও তার সহেযাগীরা। বিতর্কিত কর্মী বাইরের ব্যাংক হতে না এনে অতি কম খরচে পর্যায়ক্রমে চুক্তিভিত্তিক ব্যাংক এর অস্থায়ী কর্মীদের চাকরি স্থায়ী করা সম্ভব বলেও কর্মরতরা জানান। কর্মরতরা তাদের আবেদনে স্বেচ্চাচারি এমডি মাশিউল হক চৌধুরী এবং তার সহযোগিদের বৈষম্য, অনিয়ম ও দুর্নীতির হাত থেকে ব্যাংক এবং তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ ব্যাংকের নিরীহ কর্মচারী ও কর্মীবৃন্দকে বাঁচানোর আকুল আবেদন জানান।

অভিযোগগুলোর বিষয়ে জানতে চাইলে কমিউনিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাশিউল হক চৌধুরী জানান, তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ গুলো মিথ্যা। তিনি কোনো ধরণের অনিয়ম, দুর্নীতির সাথে জড়িত নন। অনেক ঝুঁকি জেনেও বেক্সিমকো সুকুকে ২০ কোটি টাকা বিনিয়োগ কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেণ, সব তো বোর্ড অনুমোদন দিয়েছে। এখানে আমার একার সিদ্ধান্তে কিছু হয়নি। বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের যথাযথ অনুমোদন সাপেক্ষেই করা হয়েছে।
রংধনু গ্রুপকেও এত টাকা বিনিয়োগ কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, রংধনু গ্রুপ পুলিশ হাউজিং সোসাইটিতে কাজ করছে। এটি তো পুলিশেরই কাজ। এই কাজটি যাতে একটু তাড়াতাড়ি হয়, তাই আমরা তাদের একটু বেশি ঋণ দিয়েছি। তিনি বলেন, তারা জমির ভরাটসহ হাউজিংয়ের কাজ করছে। এতে অনেক টাকার প্রয়োজন হচ্ছে। এছাড়া তারা তো সময়মত টাকা পরিশোধও করছে। অল্প সময়ের মধ্যে পদোন্নতিরি বিষয়ে জানতে চাইলে এমডি বলেন, ভালো কাজ করলে তো পদোন্নতি পেতেই পারেন। এখানে আমি কোনো সমস্যা দেখছি না।

 

জা ই / এনজি

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *