বিশেষ প্রতিবেদন
মোহাম্মদ জাফর ইকবাল
১৮ মে ২০২৫
ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের পর নিজেদের স্থলবন্দর ব্যবহার করে বাংলাদেশি পোশাকসহ বেশকিছু পণ্যের আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ভারত। গত শনিবার ভারতের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন বৈদেশিক বাণিজ্য অধিদপ্তর (ডিজিএফটি) এ সংক্রান্ত একটি নির্দেশনা জারি করে। নির্দেশনায় বলা হয়, বাংলাদেশের নির্দিষ্ট কিছু পণ্য স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়েছে ও তাৎক্ষণিকভাবে তা কার্যকর হবে। এদিকে, ভারত সরকারের এই সিদ্ধান্তে সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশি পণ্য এই সীমান্ত দিয়ে ভারতে না প্রবেশ করার কারণে পণ্য ওঠানো-নামানোর কাজে কর্মরত শ্রমিকের রুটি রুজিতে টান পড়ার ভারতীয় আমদানিকারকদের প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন অনেকে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভারত সরকারের এই সিদ্ধান্তে নিশ্চিতভাবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে পরিবহণ ব্যয় কিছুটা বেড়ে যাবে। তবে তার চেয়েও সরকারের এই সিদ্ধান্তে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের কপালে চিন্তার ভাঁজ আরও বেশি পড়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, স্থানীয় ব্যবসায়ীরা যেমন আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবেন, ঠিক সেভাবেই আমদানি বন্ধ হলে বড় ধরণের অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়তে হবে ভারতীয় ট্রাক মালিক, চালক ও বন্দরে কর্মরত শ্রমিকদের।
সূত্র জানায়, আজ রোববার সকাল থেকে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ির ফুলবাড়ী শুল্ক পয়েন্টে প্রতিদিনের মতোই বাংলাদেশে যাচ্ছে পাথর। তবে দুপুর পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে সেভাবে কোনো গাড়ি ভারতে ঢুকতে দেখা যায়নি। বাংলাদেশ থেকে মূলত কাটা কাপড়, তুলার বর্জ্য, ফলের স্বাদযুক্ত পানীয়, কার্বনেটেড পানীয় ও প্রক্রিয়াজাত খাবার ভারতে আসে ফুলবাড়ী সীমান্ত দিয়ে। ফুলবাড়ী এক্সপোর্ট ইমপোর্ট ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য ও স্থানীয় এক্সপোর্টার শুভংকর নস্কর গণমাধ্যমকে জানান, ফুলবাড়ী শুল্ক পয়েন্ট দিয়ে মূলত বাংলাদেশ থেকে কাঠের আসবাবপত্র, ফলের স্বাদযুক্ত পানীয়, কার্বনেটেড পানীয়, চিপস, তুলার বর্জ্য- এই ধরনের পণ্য আমদানি হতো। স্থলপথে সবচেয়ে কম দূরত্বের মধ্যে এই ফুলবাড়ি সীমান্ত দিয়ে কাজ হতো। কিন্তু এখন তার পরিবর্তে কলকাতা ও মহারাষ্ট্রের নাভা শেভা সমুদ্র বন্দর ব্যবহারের নির্দেশনা আসায় বাংলাদেশের পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ব্যয় বাড়বে ও তারা সমস্যায় পড়বেন। ভারতের অর্থনীতিতেও এর একটা প্রভাব পড়বে বলে অভিমত তার।
ফুলবাড়ী স্থলবন্দরের ট্রাক ওনার্স প্রেসিডেন্ট মুজিবুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, বাংলাদেশ থেকে পাট, কাটা কাপড় ও তুলা আসতো। কিন্তু এই ফুলবাড়ি সীমান্ত দিয়ে পণ্য পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা জারি হওয়ার কারণে বাংলাদেশকে অন্য পথে এসব পণ্য রপ্তানি করতে হবে। এতে পরিবহণ খরচ বেড়ে যাবে ও সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কিছুটা প্রভাব পড়বে। তিনি আরও বলেন, কেন্দ্রীয় সরকারের এই সিদ্ধান্তে ভারতের অর্থনীতিতেও বেশ প্রভাব পড়তে পারে।
সূত্র মতে, ভারতের এই নিষেধাজ্ঞার ফলে এখন থেকে বাংলাদেশ থেকে কোনো তৈরি পোশাক ভারতের মহারাষ্ট্রের নাভা শেভা ও কলকাতা সমুদ্রবন্দর ছাড়া অন্য কোনো স্থলবন্দর দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। পাশাপাশি আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও মিজোরামের কোনো শুল্ক পয়েন্ট এবং পশ্চিমবঙ্গের চ্যাংড়াবান্ধা ও ফুলবাড়ী শুল্ক পয়েন্ট দিয়ে ফল, ফলের স্বাদযুক্ত পানীয়, কার্বনেটেড পানীয়, প্রক্রিয়াজাত খাবার, তুলাবর্জ্য, প্লাস্টিকের পণ্য (শিল্প-উৎপাদনের নির্দিষ্ট কাঁচামাল ছাড়া) ও কাঠের আসবাবপত্র আমদানি করা যাবে না। যদিও ওই নিষেধাজ্ঞা মাছ, এলপিজি, ভোজ্যতেল ও চূর্ণ পাথরের ক্ষেত্রে কার্যকর হবে না।
নিষেধাজ্ঞার নেপথ্যে :
স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ভারত। যার প্রভাব পড়বে আনুমানিক ৭৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্যের ওপর। এটি মোট দ্বিপাক্ষিক আমদানির প্রায় ৪২ শতাংশ। এমন তথ্য জানিয়েছে গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ (জিটিআরআই)। সংস্থাটি জানিয়েছে, ভারতের এই পদক্ষেপ এককভাবে নেওয়া নয় বরং বাংলাদেশ কর্তৃক ভারতীয় রপ্তানির ওপর আরোপিত নানা বাধা এবং চীনের প্রতি ঢাকার কূটনৈতিক ঝোঁকের প্রতিক্রিয়ায় এসেছে। জানা গেছে, ২০২৫ সালের মার্চে ড. ইউনূসের চীন সফরের সময় ২ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ ও সহযোগিতা চুক্তি সই হয়। তাছাড়া শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশে যে পরিবর্তন এসেছে তা মূলত চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে ভারত। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এএনআই-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের শেষ থেকে বাংলাদেশ একাধিক ভারতীয় রপ্তানি পণ্যে সীমাবদ্ধতা আরোপ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে স্থলবন্দর দিয়ে ভারতীয় সুতা আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা, চাল রপ্তানিতে কঠোর নিয়ন্ত্রণ এবং কাগজ, তামাক, মাছ ও গুঁড়োদুধের আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা। তাছাড়া বাংলাদেশ ভারতীয় পণ্য পরিবহনে ট্রানজিট ফি আরোপ করেছে। ভারতীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে, এসব বিধিনিষেধ ও কঠোর কাস্টমস কার্যক্রম ভারতীয় রপ্তানিকারকদের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করেছে। এই বাণিজ্যিক টানাপোড়েন ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জন্যও সমস্যার সৃষ্টি করছে। বাংলাদেশের ট্রানজিট ফি ও নিষেধাজ্ঞা ওই অঞ্চলের শিল্প উন্নয়নে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বলেও দাবি করা হয়।
সময়-খরচ বাড়বে :
স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পণ্য পাঠানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা দেশটিতে বাংলাদেশের রপ্তানিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। ভারতের নিষেধাজ্ঞা বিষয়ে বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন গণমাধ্যমে বলেন, ধারণা করা হচ্ছে বাংলাদেশ সমুদ্র ও স্থলবন্দর দিয়ে ভারতীয় সুতা আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর এ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলো ভারত। তিনি বলেন, পোশাক রপ্তানিকারকদের জন্য সব স্থলবন্দর বন্ধ রয়েছে। এটি ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত করবে। কারণ আমাদের রপ্তানি আয়ের বেশিরভাগই তৈরি পোশাক থেকে আসে এবং এর সিংহভাগ স্থলবন্দর দিয়ে পাঠানো হয়। অন্যদিকে, প্রক্রিয়াজাত খাবার বেশিরভাগই সেভেন সিস্টারস (উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো) অঞ্চলের জন্য। যেহেতু তাদের কলকাতা দিয়ে রপ্তানি করতে হয়, তাই সময় ও খরচ বাড়বে। ফলে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারানোর কারণে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। সুতরাং এ নিষেধাজ্ঞার ফলে ভারতে আমাদের রপ্তানি কমে যাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
কীভাবে এ সমস্যার সমাধান হতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে সমাধানের অংশ হিসেবে বাংলাদেশকে প্রথমে জানতে হবে কেন এটি আরোপ করা হয়েছে, তারপর দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে উভয় দেশকে একটি ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে। আর ভারত সরকারের উচিত কারণ ব্যাখ্যা করা কেন তারা এ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এটা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের স্বচ্ছতার অংশ। আমরা যদি চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার সাম্প্রতিক পাল্টা শুল্ক আরোপের দিকে তাকাই, তারা নতুন শুল্কহার সম্পর্কে ব্যাখ্যা করেছে, কেন এই সমস্যাগুলো ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে সমাধান করা উচিত সেটা জানিয়েছে। নতুন নিষেধাজ্ঞা ভারতে রপ্তানি করা ব্যবসায়ীদের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে।
আটকে গেছে পণ্যবাহী ট্রাক :
ভারতের আমদানি বিধিনিষেধের কারণে বুড়িমারী স্থলবন্দরে আটকে গেছে খাদ্যপণ্যবাহী ২০টি ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান। এরমধ্যে ১০টি খালি ট্রাক রয়েছে। যানগুলো রোববার সকালে বুড়িমারী সীমান্ত পার হয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ি যাওয়ার কথা ছিল। বুড়িমারী কাস্টম কর্মকর্তা রাশেদ জানান, ভারতে রপ্তানির জন্য প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ, সজীব গ্রুপ ও আকিজ গ্রুপের ২০টির মতো বিভিন্ন ধরনের খাদ্যপণ্যবোঝাই ট্রাক আটকা রয়েছে। শনিবার দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এসব পণ্যবাহী ট্রাক বুড়িমারী স্থলবন্দরে এসে পৌঁছায়।
বুড়িমারী স্থলবন্দরের সহকারী কমিশনার রাহাত হোসেন বলেন, ভারত কিছু খাদ্যপণ্য ও তুলার সুতার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এজন্য বুড়িমারী স্থলবন্দর থেকে এসব মালামাল ভারতে যাচ্ছে না।
এই নিষেধাজ্ঞার আগেই পণ্যবোঝাই ট্রাক ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে বেনাপোল বন্দরের উদ্দেশে ছেড়ে আসা রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের ৩৬টি ট্রাক তৈরি পোশাক নিয়ে বেনাপোল বন্দরে অপেক্ষা করছে। এসব পণ্যের রপ্তানির ভবিষ্যৎ নিয়েও শঙ্কা দেখা দিয়েছে। যদিও পণ্যের চালানগুলো বেনাপোল থেকে ফিরিয়ে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের দিকে নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান। রপ্তানিকারকেরা বলেন, ভারতের এই প্রজ্ঞাপনে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানা ক্ষতির মুখে পড়বে। বেনাপোল স্থলবন্দরের তুলনায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর দিয়ে পণ্য ভারতে পাঠাতে দ্বিগুণ খরচ হবে। একই সঙ্গে পণ্য পৌঁছাতেও কয়েক গুণ বেশি সময় লেগে যাবে। এতে ক্রয়াদেশ কমে যাবে।
ঢাকার তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান জেকে এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী জাহাঙ্গীর আলম গণমাধ্যমে বলেন, বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে এক ট্রাক তৈরি পোশাক কলকাতায় পৌঁছাতে শুল্কায়ন, জিএসটি, ট্রাকভাড়া, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট খরচ সব মিলিয়ে ৬ লাখ টাকা খরচ হয়। সর্বোচ্চ তিন দিনের মধ্যেই পণ্যের চালান গন্তব্যে পৌঁছে যায়। সেখানে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে এক ট্রাক পণ্য কলকাতায় পাঠাতে প্রায় ১২ লাখ টাকা খরচ হবে। সময় লাগবে ২০ থেকে ২৫ দিন। এতে ছোট ছোট উদ্যোক্তারা মার খাবেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেনাপোল কাস্টমস হাউজের অতিরিক্ত কমিশনার শরিফ হাসান বলেন, ভারতের চিঠির আলোকে তৈরি পোশাকের ট্রাক স্থলবন্দর দিয়ে প্রবেশ করার সুযোগ নেই। দুপুর একটা পর্যন্ত ভারতে প্রবেশের অপেক্ষায় ৩৬টি ট্রাক তৈরি পোশাক নিয়ে বেনাপোল বন্দরে দাঁড়িয়ে ছিল বলে তিনি জানান।
বিশেষজ্ঞদের মতামত :
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) এর চেয়ারম্যান জায়েদি সাত্তার বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে ভারতের পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ভারত সরকার যে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে, তা দুই দেশের বাণিজ্যের জন্য ভালো খবর নয়। দুই দেশের মানুষের জন্যও এটা ভালো পদক্ষেপ নয়। এতে আঞ্চলিক বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হবে। ভারতের এই বিধিনিষেধের ফলে এখন আমাদের বাণিজ্য ব্যয় বেড়ে যাবে। কারণ, এখন অনেক পথ ঘুরে ভারতে পণ্য রপ্তানি করতে হবে। আগে সহজে বিভিন্ন স্থলবন্দর ব্যবহার করে দেশটিতে পণ্য পাঠানো যেত। কয়েক বছর ধরে ভারতে আমাদের পোশাক রপ্তানির পরিমাণ বাড়ছিল। দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি বা সাফটার আওতায় দেশটিতে আমাদের রপ্তানি বাড়ছিল। এখন সেখানে ভাটা পড়তে পারে। আমার মনে হচ্ছে, আমরা পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপের মাধ্যমে এগোচ্ছি। প্রথমে তারা ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করল। পরে আমরা স্থলপথে সুতা আমদানি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিলাম। যদিও সুতা আমদানি নিয়ে বস্ত্রকল ও পোশাকশিল্পের মালিকদের মধ্যে দুই রকম বক্তব্য রয়েছে। স্থানীয় শিল্প হয়তো এতে লাভবান হবে। তারপরও যেকোনো সিদ্ধান্ত বা পদক্ষেপ নেওয়ার আগে সব দিক ভালোভাবে বিবেচনায় নেওয়া উচিত। নতুন করে ভারত যে পদক্ষেপ নিয়েছে, তার বিপরীতে আমাদের পাল্টা পদেক্ষপ নেওয়া ঠিক হবে না। কারণ, আমাদের সেই বাজার সক্ষমতা (মার্কেট পাওয়ার) নেই। নিজেদের ক্ষতি করে অন্যের ক্ষতি করার চিন্তা করা যাবে না। তাই এখন পাল্টা পদক্ষেপ না নিয়ে কূটনৈতিকভাবে এই বাধা দূর করার চেষ্টা করা উচিত। ভারতের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যঘাটতি রয়েছে, তবে এটা দুর্বলতা নয়। কারণ, ভারত থেকে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতেই প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানি করা হয়।
তিনি আরও বলেন, চীনের সঙ্গেও আমাদের অনেক বাণিজ্যঘাটতি রয়েছে। কিন্তু এটা কোনো সমস্যা নয়। রপ্তানির জন্য প্রয়োজনের তাগিদে আমাদের আমদানি করতে হয়। তাই বাণিজ্যঘাটতি কোনো খারাপ বিষয় নয়। ভারতের সঙ্গেও আমাদের ‘উইন উইন’ বাণিজ্য পরিস্থিতি ছিল। এখন সেটা ‘ক্ষতি ক্ষতি’ অবস্থায় চলে যাচ্ছে। এটা হওয়া উচিত হবে না। কোনো দেশের জন্যই লাভের কিছু হবে না। তাই কূটনৈতিকভাবেই দ্রুত সমাধানে উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
বাণিজ্যে কারা এগিয়ে :
বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে বরাবরই ভারত এগিয়ে। তার মানে, ভারত থেকে বাংলাদেশ যে পরিমাণ পণ্য আমদানি করে, তার তুলনায় রপ্তানি খুবই নগণ্য। সর্বশেষ গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ভারত থেকে বাংলাদেশ ৯০০ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। তার বিপরীতে বাংলাদেশ থেকে ভারতে পণ্য রপ্তানি হয়েছে মাত্র ১৫৭ কোটি ডলারের।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বিশ্লেষণ করে এই চিত্র পাওয়া গেছে। ২০১১ সালে ভারত বাংলাদেশকে অস্ত্র ও মাদক বাদে সব পণ্যে শুল্কমুক্ত রপ্তানির সুবিধা দেয়। যদিও সেটা তেমন কাজে লাগাতে পারছিল না বাংলাদেশ। তবে ধীরে ধীরে দেশটিতে রপ্তানি বাড়তে থাকে। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ থেকে ভারতে পণ্য রপ্তানি ১ বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়। অবশ্য ভারতের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি আবার হোঁচট খাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। কারণ, শনিবার নতুন করে স্থলপথে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাকসহ বেশ কিছু পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে ভারত সরকার।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, তারা বিষয়টি নিয়ে সরকারি পর্যায়ে আলাপ আলোচনার পাশাপাশি ভারতের সঙ্গেও এ নিয়ে আলোচনার কথা ভাবছে। এর আগে গত এপ্রিলে ট্রান্সশিপমেন্টের মাধ্যমে নিজ দেশের বন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে বাংলাদেশের পণ্য যাওয়ার ব্যবস্থাও প্রত্যাহার করে ভারত। গত মাসে ভারতের সেন্ট্রাল বোর্ড অব ইনডাইরেক্ট ট্যাক্সেস অ্যান্ড কাস্টমস (সিবিআইসি) এ সুবিধা বাতিলে আদেশ জারি করে। ২০২০ সালের ২৯ জুন এ সংক্রান্ত এক আদেশে এই সুবিধা দেওয়া হয়েছিল।
ইপিবির তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে ভারতে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয় তৈরি পোশাক। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ভারতে ৫৪ কোটি ৮৮ লাখ ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছেন বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা। ভারত স্থলপথে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানি নিষিদ্ধ করায় এ ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করছেন বাংলাদেশের রপ্তানিকারকেরা। এ ছাড়া ভারতের নতুন বিধিনিষেধের কারণে কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্য রপ্তানিতে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে বলে বলছেন খাতটির রপ্তানিকারকেরা। গত অর্থবছর ভারতে ১৫ কোটি ৬৮ লাখ ডলারের কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে।
ইপিবির তথ্যানুযায়ী, গত অর্থবছর বাংলাদেশ থেকে ভারতে ৪ কোটি ৪০ লাখ ডলারের প্লাস্টিক পণ্য, ৩ কোটি ১৩ লাখ ডলারের তুলা ও তুলার সুতার ঝুট ও ৬৫ লাখ ডলারের আসবাব রপ্তানি হয়। স্থলবন্দর ব্যবহার করে এসব পণ্য বেশি রপ্তানি হতো। এখন স্থলবন্দর দিয়ে রপ্তানিতে বিধিনিষেধ দিয়েছে ভারত। ফলে এসব পণ্যের রপ্তানিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
কি বলছেন উপদেষ্টা :
বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানিতে ভারতের বিধিনিষেধের বিষয়ে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানেন না বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। তবে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে বিষয়টি জেনেছেন তিনি। তার ভিত্তিতে বিচার বিশ্লেষণ শুরু হয়েছে, বাংলাদেশের কী করণীয়, তা নির্ধারণের কাজ শুরু হয়ে গেছে। গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। ভারতের এমন সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে কি না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, ভারতে আমাদের আসবাব খুব বেশি রপ্তানি হয় না, সেই তুলনায় পোশাকের বড় রপ্তানি হয়। আমাদের দেশ থেকে যে রপ্তানি হয়, তার মূল কারণ প্রতিযোগিতা সক্ষমতা। আমরা আশা করছি, উভয় দেশের ভোক্তা ও ব্যবসায়ীর স্বার্থে এটা চলমান থাকবে।
ট্রান্সশিপমেন্ট বন্ধের ধারাবাহিকতায় এটা হয়েছে কি না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্য উপদেষ্টা আরও বলেন, তার ধারাবাহিকতায় হয়নি। এর ফলে ভারতের ব্যবসায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ভৌগোলিক কারণে আমরা পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। পরিস্থিতি বুঝতে দু-এক দিন লাগবে, এরপর করণীয় ঠিক করা হবে।
জা ই / এনজি