নিজস্ব প্রতিবেদক
১৭ মে ২০২৫
‘যুক্তরাষ্ট্রের পারষ্পরিক শুল্ক এবং বাংলাদেশের কর্ম-পরিকল্পনা’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা। ছবি- ঢাকা মেইল
দেশের রফতানি খাতের সুরক্ষা ও টেকসই করার লক্ষ্যে রাজনৈতিক সংস্কারের পাশাপাশি বাংলাদেশের কূটনৈতিক ও কৌশলগত উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি বলে মনে করেন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকীন আহমেদ।
শনিবার (১৭ মে) ডিসিসিআই এবং বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট (বিল্ড) আয়োজিত ‘যুক্তরাষ্ট্রের পারষ্পরিক শুল্ক এবং বাংলাদেশের কর্ম-পরিকল্পনা’ শীর্ষক সেমিনারে তিনি এ কথা বলেন।
সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মাহবুবুর রহমান। বিশেষ অতিথি ছিলেন ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স-বাংলাদেশের সভাপতি মাহবুবুর রহমান। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
এ সময় স্বাগত বক্তব্যে ডিসিসিআই সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, ‘ক্রমবর্ধমান ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং বৈশ্বিক বাণিজ্যের গতিশীলতার পরিবর্তনের সন্ধিক্ষণের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ।’
তিনি উল্লেখ করেন, ‘নিজেদের অপ্রচলিত বাজার সম্প্রসারণ, মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিকে ত্বরান্বিত করা, কার্যকর ও কৌশলগত অর্থনৈতিক কূটনীতির জোরারোপ, নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে প্রতিযোগিতা সক্ষমতার উন্নতি ও মানব সম্পদের দক্ষতার বিকাশে উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন।’
এছাড়া স্বল্প সময়ের মধ্যে প্রস্তাবিত শুল্ক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য সরকারি-বেসরকারি খাতের সম্পৃক্তকরণের মাধ্যমে একটি কৌশলগত উদ্যোগ গ্রহণ অপরিহার্য বলে মত প্রকাশ করেন তাসকীন আহমেদ।
সর্বোপরি মার্কিন পারষ্পরিক শুল্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কূটনৈতিক ও কৌশলগত পদক্ষেপ গ্রহণ, রফতানির বাজার রক্ষা ও সম্প্রসারণের রাজনৈতিক উদ্যোগ ও প্রয়োজনীয় সংস্কার, নিজেদের রফতানি বহুমুখীকরণের পাশাপাশি ব্যবসায়িক অংশীদারদের সম্পর্ক উন্নয়নের উপর তিনি জোরারোপ করেন।
বিদ্যমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের কার্যক্রম বেশ ইতিবাচক, তবে গোছালো নয় উল্লেখ করে এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সকলের পরামর্শে সরকার সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন ডিসিসিআই সভাপতি।
বিল্ড চেয়ারপারসন আবুল কাসেম খান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের সম্ভাবতা যাচাই, রফতানি পণ্যের বহুমুখীকরণে পর্যাপ্ত নীতি সহায়তা নিশ্চিতকরণ, নতুন বাজার সম্প্রসারণে রোডম্যাপ প্রণয়ন, আসিয়ানের সদস্যভুক্তির জন্য বাংলাদেশের সক্ষমতা বাড়ানো, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ প্রক্রিয়া সহজীকরণে সরকারি সহায়তার দীর্ঘসূত্রিতা হ্রাস, বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ দান এবং সরবরাহ শৃঙ্খল ব্যবস্থাপনার ব্যয় হ্রাসের সক্ষমতা বাড়ানোর উপর তিনি জোরারোপ করেন।
বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানি বাড়িয়ে দুদেশের বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে আমরা আগ্রহী এবং এ লক্ষ্যে দ্বিপাক্ষিক কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা আমদানিতে বাংলাদেশে ওয়ারহাউজ স্থাপনের কথা ইতোমধ্যে বলা হয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে দীর্ঘমেয়াদে এলএনজি আমদানির চুক্তি করা হয়েছে, যার মাধ্যমে দুদেশের মধ্যকার ১ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য বাড়বে। তৃতীয় দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য আমদানির বিষয়টি প্রথম আলোচনা পর্বে উপস্থাপন করা হবে, যেন তারা এটাকে সরাসরি বাণিজ্য হিসেবে গণ্য করে। এক্ষেত্রে সেবাখাতে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হবে।
আইসিসি বাংলাদেশ-এর সভাপতি মাহবুবুর রহমান বলেন, আমাদেরকে সঠিক পদ্ধতিতে কার্যকরভাবে নেগোসিয়েশন চালিয়ে যেতে হবে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে পারষ্পরিক শুল্ক আরোপ করেছে, তা কাম্য নয়। বর্তমান সরকারের সঙ্গে বেসরকারি খাতের সম্পৃক্তকরণ আশানুরূপ নয়। তাই সরকারের সঙ্গে উদ্যোক্তাদের সম্পর্ক আরও জোরালো হতে হবে।
তবে কোনো একক বাজারের উপর রফতানি নির্ভরশীলতা কমিয়ে নতুন গন্তব্য যেমন- এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার প্রতি আমাদের মনোনিবেশ বাড়ানো প্রয়োজন বলে তিনি মত প্রকাশ করেন। উচ্চমানের বহুমুখী পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে আমাদের দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন ও প্রতিযোগী সক্ষমতা বাড়াবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
মূল প্রবন্ধে সিপিডির ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য উল্লেখ করেন, এ পরিস্থিতিকে অনেকেই দুর্যোগ হিসেবে বিবেচনা করছেন। তবে আমাদের এটিকে একটি সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। আরোপিত পারষ্পরিক শুল্কের প্রভাব মূলত পড়বে ভোক্তার উপর এবং বৈশ্বিক বাজার সেটাকে ইতিবাচক হিসেবে গ্রহণ করবে না। এটি কতটা কার্যকর হবে, সে বিষয়ে তিনি সংশয় প্রকাশ করেন। এছাড়া বিষয়টি কেবল অর্থনৈতিক নয়, বরং অনেকাংশেই ভূ-রাজনৈতিক বলে তিনি অভিমত জ্ঞাপন করেন।
এ প্রসঙ্গে তিনি জানান, যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক আরোপের ক্ষেত্রে সেবা খাতকে প্রাধান্য না দিয়ে পণ্য বাণিজ্যকে বেশি হারে গুরুত্ব দিয়েছে। বিষয়টি বাংলাদেশের নেগোসিয়েশনের ক্ষেত্রে সেবা খাতকে প্রাধান্য দিয়ে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা চালানো প্রয়োজন বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও জানান, যুক্তরাষ্ট্রের বিবেচনায় এলডিসিভুক্ত দেশগুলোর বাজার ততটা গুরুত্বপূর্ণ না হলেও আমাদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজার যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। তাই বিষয়টি নিয়ে সুগঠিত, বহুমাত্রিক এবং বেসরকারিখাতকে সম্পৃক্ত করে কার্যকর পদক্ষেপ দ্রুত গ্রহণ করতে হবে।
সেমিনারে নির্ধারিত আলোচনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মো. মেসবাউল হক, ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি ও শাশা ডেনিমস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস মাহমুদ, পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও সিইও ড. এম মাশরুর রিয়াজ এবং বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস এসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার রাজিব হায়দার অংশগ্রহণ করেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মো. মেসবাউল হক বলেন, ‘বাজারে টাকার সরবরাহ বেশ ভালো। তবে শিল্পখাতের আর্থিক চাহিদা মেটাতে ব্যাংক খাতের উপর বেশি নির্ভরশীল হওয়ায় ব্যাংক ব্যবস্থার উপর চাপ প্রতিনিয়িত বাড়ছে। আর্থিক খাতের বাজারে কাঠামোগত দক্ষতা বাড়ানো না গেলে আর্থিক ব্যবস্থাপনায় স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে না।
পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও সিইও ড. এম মাশরুর রিয়াজ বলেন, যুক্তরাষ্ট্র কী চায় এবং তাদের ভূ-অর্থনৈতিক প্রাধিকার কী, সেটা আমাদের আগে জানতে হবে এবং সে অনুযায়ী কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তুলা, সয়াবিন, এলএনজি- এ তিনটি পণ্যের আমদানি বাংলাদেশে ক্রমাগত বাড়ছে। তাই এ ধরনের সম্ভাবনাময় পণ্য নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা অব্যাহত রাখতে হবে।
মাশরুর রিয়াজ বলেন, ‘দীর্ঘমেয়াদে আমাদের প্রতিযোগী সক্ষমতা বাড়াতে লজিস্টিক খাতে সক্ষমতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। কারণ পার্শ্ববর্তী প্রতিযোগী দেশের চাইতে এ খাতে আমাদের ব্যয় তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি।’
ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি ও শাশা ডেনিমসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস মাহমুদ বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে ভোক্তাদের চাহিদা কমার ফলে আমাদের রফতানি কমে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে।’
তিনি বলেন, তৃতীয় কোনো দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে তারা যেন বিষয়টিকে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি হিসেবে গণ্য করে, সেটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা পর্বে উত্থাপন করতে হবে। বর্তমান সরকার যে সংষ্কার কার্যক্রমগুলো হাতে নিয়েছে, তা স্বল্প সময়ে বাস্তবায়নের উপর তিনি জোরারোপ করেন।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস এসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার রাজিব হায়দার বলেন, চাহিদা মতো জ্বালানি সরবরাহ না থাকার কারণে বস্ত্র খাতের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজের প্রায় ৪০ শতাংশ উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। তাই শিল্পের চাহিদা মেটাতে এলএনজি আমদানির উপর তিনি জোরারোপ করেন।
তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের তুলা তুলনামূলক বেশ দামি এবং গুণগত মানও বেশ ভালো। তবে আমদানিতে তিন মাসের বেশি সময় লেগে যাওয়ায়। এ খাতের উদ্যোক্তারা তুলা আমদানিতে নিরুৎসাহিত হন। এ সমস্যা সমাধানে আমেরিকার তুলা রফতানিকারকদের বাংলাদেশে ওয়ারহাউজ সুবিধা দিলে তুলার আমদানি চার গুণ বৃদ্ধি পাবে।
ডিসিসিআইয়ের ঊর্ধ্বতন সহসভাপতি রাজীব এইচ চৌধুরী, সহসভাপতি মো. সালিম সোলায়মান, পরিচালনা পর্ষদের সদস্যবৃন্দ, সাবেক সভাপতি আফতাব-উল ইসলাম, ওসামা তাসীর এবং ব্যারিস্টার মো. সামির সাত্তারসহ সরকারি-বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিরা সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন।
টি আই / এনজি