জেলা প্রতিনিধি রাজশাহী
১৬ মে ২০২৫
প্রমত্তা পদ্মার বুকে এখন ধু ধু বালুচর। ফারাক্কার প্রভাবে দিনদিন শুকিয়ে যাচ্ছে নদীটি। চার দশকে পদ্মার আয়তন কমেছে অর্ধেক। নদীতে জেগে ওঠা বিস্তীর্ণ চর দেখে বোঝার উপায় নেই এটি কোনো নদী। গেলো কয়েক বছরে এ অঞ্চলে পদ্মার বেশকিছু শাখা নদীও শুকিয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে লাখ লাখ কৃষক।
বর্ষা ছাড়া পদ্মার রাজশাহী পয়েন্টে পানির দেখা মিলে না। বছরে ২-১ মাস নদীতে পানি থাকে আর বাকি সময়জুড়ে বালু আর বালু। যার ফলে গত এক দশকে রাজশাহী ও আশপাশের এলাকায় কোনো ধরনের বন্যা হয়নি।
ফারাক্কার সরাসরি শিকার রাজশাহীর মানুষ। পানির প্রবাহ কম থাকায় নদীর তলদেশ ক্রমান্বয়ে ভরাট হচ্ছে। কয়েক প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। গঙ্গার ডলফিন ও ঘড়িয়াল আর দেখা যায় না। আগের মতো পদ্মায় ইলিশের ঝাঁক আসে না। নদীকেন্দ্রীক নানা ধরনের পেশা হারিয়ে লাখ লাখ মানুষের জীবনে নেমে এসেছে বিপর্যয়।
পানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যতদিন পদ্মা নিজস্ব ধারায় চলতে পেরেছে ততদিন এটির রূপ ছিল প্রমত্তা। কিন্তু ১৭৭৫ সালের এপ্রিলে ভারতে ফারাক্কা বাঁধ প্রতিষ্ঠার পর থেকে দিন যত যাচ্ছে রুগ্ন হচ্ছে পদ্মা। রাজশাহী পয়েন্টে খরা মৌসুমে পানির উচ্চতা কমেই চলেছে। এ বছর গত ১২ মে এখানকার পানির উচ্চতা নেমে যায় ৬ দশমিক ৯৫ মিটারে। চলতি বছরে এটিই সর্বনিম্ন স্তর। বর্ষা মৌসুমেও এখন আর আগের মত পানির প্রবাহ থাকে না।
এক গবেষণায় দেখা যায়, ১৯৮৪ সালের তুলনায় শুষ্ক মৌসুমে রাজশাহী অংশের আয়তন কমেছে ৫০ শতাংশ। পানির গভীরতা কমেছে ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ। প্রবাহ কমেছে ২৬ দশমিক ২ শতাংশ। দক্ষিণের সুন্দরবনে মিঠাপানির সরবরাহ কমেছে ৯০ শতাংশ। ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারিতে গঙ্গায় পানি প্রবাহের পরিমাণ ছিল ৯০ হাজার ৭৩০ কিউসেক। ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারিতে পানি প্রবাহের পরিমাণ ছিল ৭৫ হাজার ৪০৯ কিউসেক। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে গঙ্গায় পানি প্রবাহ কমেছে ১৫ হাজার ৩২১ কিউসেক। যদিও সে বছর গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল পূর্ববর্তী বছর গুলোর তুলনায় ১৯ দশমিক ২ শতাংশ কম।
বৃহস্পতিবার রাজশাহীতে ফারাক্কার ক্ষতিকর দিক নিয়ে সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বলা হয়, গঙ্গাসহ ভারত শতাধিক অভিন্ন নদীর পানি অন্যায়ভাবে প্রত্যাহারের ফলে উত্তরাঞ্চলের প্রায় দুই কোটি কৃষক সেচের পানির অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। দেশের দক্ষিণ ও মধ্যাঞ্চলের প্রায় চার কোটি মানুষ সেচের পানির অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। গঙ্গা-কপোতাক্ষ প্রজেক্টে পানি স্বল্পতার কারণে ৬৫ শতাংশ এলাকায় সেচ প্রদান দারুণভাবে ব্যহত হচ্ছে। উজান থেকে স্বাদু পানির সরবরাহ কমে যাওয়ায় দেশের দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ততা বেড়ে গেছে। এর ফলে জমির উর্বরতা শক্তি কমে আসছে। বরেন্দ্র অঞ্চল বিশেষ করে উচ্চ বরেন্দ্রের একশত ভাগ গভীর নলকূপ অকেজো হয়ে গেছে। ২১ শতাংশ অগভীর নলকূপ প্রায় অকার্যকর। ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের বিষাক্ত প্রভাবে উত্তর ও উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের অনেক জেলায় নলকূপের পানি খাবার অযোগ্য হয়ে পড়েছে। বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় প্রচলিত ধান উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। স্বাদু পানির অভাবে খুলনা ও সাতক্ষীরা অঞ্চলে সুন্দরবনের প্রাণবৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুর রহমান অঙ্কুর জানান, ‘ভারতের সঙ্গে যে চুক্তি রয়েছে সে অনুযায়ী আমরা হয়তো পানি পাচ্ছি। কিন্তু এ পানি আমাদের জন্য পর্যাপ্ত নয়। আগামী বছর পানি চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে। এর পর নতুন করে এটি নিয়ে আলোচনা হবে। তখন বিষয়গুলো উঠে আসবে।’
এ বিষয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিজবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক সারওয়ার জাহান বলেন, ‘ফারাক্কা ব্যারেজের সবচেয়ে বড় সমস্যা পানির অভাব। পদ্মার পানির স্তর কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এর সংযুক্ত নদীগুলো পানিহীন হয়ে পড়েছে। মাহানন্দা, আত্রাই, পুনর্ভবা ও বার্নাই নদীতে পানি নেই। সংযুক্ত খাল, জলাশয় ও ভূগর্ভস্থ জল ধীরে ধীরে নিচে নামছে।’
নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, ‘ফারাক্কার প্রভাবে এ অঞ্চলের মানুষ চরম ক্ষতির শিকার হচ্ছে। পৃথিবীর কোনো দেশের সঙ্গে প্রতিবেশী রাষ্ট্র এমন আচরণ করেনি। আমাদের এখন ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। নিজেদের দাবির প্রতি সোচ্চার থাকতে হবে। এখানে নতজানু পররাষ্ট্রনীতির কোনো সুযোগ নেই।’
তিনি বলেন, ‘নতুন চুক্তিতে ১৯৭৭ সালের চুক্তির মতো গ্যারান্টি ক্লস অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। যৌথ নদী কমিশনে নেপালকে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়মানুযায়ী যথাসময়ে বৈঠক করতে হবে।’
এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘নদী ছোট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পানি প্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে নদীর তলদেশ ভরাট হচ্ছে। এর ফলে বর্ষার মৌসুমে নদী অতিরিক্ত পানি ধারণ করতে পারছে না। একদিকে নদী শুকিয়ে দীর্ঘমেয়াদী খরা সৃষ্টি হচ্ছে।‘
টি আই / এনজি