সন্ধ্যা ৬:০৬ | শনিবার | ২৪ মে, ২০২৫ | ১০ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২, গ্রীষ্মকাল | ২৫ জিলকদ, ১৪৪৬

আ’লীগের দেড় দশকে ৬০ হাজার ৩৭ খুন

বিশেষ প্রতিবেদন

 

 

তোফাজ্জল হোসাইন কামাল

১১ মে ২০২৫

 

 

শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ফ্যাসিস্ট  আওয়ামীলীগ সরকারের দেড় দশকের শাসনামলে সারা দেশে খুন হয়েছেন ৬০ হাজার ৩৭জন। সে হিসেবে প্রতি বছর খুন হন ৪ হাজার ২ জন। প্রতিমাসের হিসেবে ৩শ ৩৩ দশমিক ৫জন। দিনের হিসেবে ১১ দশমিক ১১জন খুন হন। এই ১৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খুন হয়েছেন ২০১৪ সালে ৪ হাজার ৫শ ১৪জন। আর সবচে কম খুন হয়েছেন ২০২৩ সালে ৩ হাজার ২৩জন। পুলিশের অপরাধ পরিসংখ্যান থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে।
এছাড়া, ওই ১৫ বছরে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে ৭ হাজার ৫৯৯টি, দস্যুতা ১৬ হাজার ৪৫টি, সিধেঁল চুরি ৪২ হাজার ৭৬৬টি ও চুরির ঘটনা ঘটেছে ১ লাখ ২৫ হাজার ৩৩১টি।

পুলিশের অপরাধ পরিসংখ্যান বলছে, বিগত ১৫ বছরে পুলিশের আটটি রেঞ্জের (৮ বিভাগ) মধ্যে সবচেয়ে বেশি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ঢাকা ও চট্টগ্রামে। মেট্রোপলিটন এলাকা হিসেবে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ- ডিএমপি ও চিটাগাং মেট্রোপলিটন পুলিশ-সিএমপিতে খুনের ঘটনা বেশি ঘটেছে। এ ছাড়া খুলনা, সিলেট, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, বরিশাল বিভাগেও (রেঞ্জ) খুনের ঘটনা ছিল উল্লেখযোগ্য সংখ্যক।

 

পুলিশের পরিসংখ্যান বলছে, আওয়ামী লীগের শাসনামলের ১৫ বছর ৮ মাসে (২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত) এই খুনের ঘটনার বাইরে রয়ে গেছে সারা দেশে গুমের পর খুনের শিকার হওয়া, বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা এবং রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘিরে সহিংসতায় ঘটা হত্যাকাণ্ডগুলো। রাজনৈতিক বিরোধে হত্যার বাইরেও পারিবারিক বিরোধ, ব্যক্তিগত বিরোধ, ব্যবসায়িক ও আর্থিক বিরোধ, অপহরণ, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তারসহ নানা ঘটনায়ও হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। নিহতদের মধ্যে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, ব্যবসায়ী, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা, আইনজীবী, সাংবাদিক, পুলিশসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ রয়েছেন। ধর্মীয় বক্তা, ব্লগার, লেখক, কবিসহ অনেকেই টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হয়েছেন। আর এসব হত্যার ঘটনায় হওয়া মামলার অধিকাংশই তদন্ত, আসামি গ্রেফতার না হওয়া, বিচার ঝুলে থাকার পর্যায়ে রয়ে গেছে।

পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে  জানান, ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সালের আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগ পর্যন্ত ১৫ বছর ৮ মাসে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যে খুব একটা ভালো ছিল তা মোটেও বলা যাবে না। দীর্ঘ এই সময়কালে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ছিল দৃশ্যমান বাস্তবতা। বিশেষ করে, বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গুমের ঘটনা ছিল উদ্বেগজনক। গুমের শিকার হয়েছেন, এমন অনেককেই নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে।

বন্দুকযুদ্ধের নামেও অনেক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, যেসব ঘটনায় মামলা পর্যন্ত হয়নি। আবার টার্গেট কিলিংয়ের ঘটনায় মামলা হলেও খুনিরা গ্রেফতার হয়নি। কোনো কোনো ঘটনায় গ্রেফতার হলেও খুনিরা জামিনে বেরিয়ে গেছে। হত্যাকাণ্ডের বিচারে দীর্ঘসূত্রতাও দেখা গেছে। চাঞ্চল্যকর অনেক খুনের মামলায় আসামিদের উচ্চ আদালত থেকে জামিনে বেরিয়ে যাওয়ারও নজির দেখা গেছে আওয়ামীলীগের শাসনামলে।

পুলিশের পরিসংখ্যান অনুসারে আওয়ামী শাসনামলের খুনের চিত্র: ২০০৯ সালে খুন ৪ হাজার ২১৯, ২০১০ সালে ৩ হাজার ৯৮৮, ২০১১ সালে ৩ হাজার ৯৬৬, ২০১২ সালে ৪ হাজার ১১৪, ২০১৩ সালে ৪ হাজার ৩৯৩, ২০১৪ সালে ৪ হাজার ৫১৪, ২০১৫ সালে ৪ হাজার ৩৬, ২০১৬ সালে ৩ হাজার ৫৯১, ২০১৭ সালে ৩ হাজার ৫৪৯, ২০১৮ সালে ৩ হাজার ৮৩০, ২০১৯ সালে ৩ হাজার ৬৫৩, ২০২০ সালে ৩ হাজার ৫৩৯, ২০২১ সালে ৩ হাজার ২১৪, ২০২২ সালে ৩ হাজার ১২৬, ২০২৩ সালে ৩ হাজার ২৩ ও ২০২৪ সালের আগষ্ট পর্যন্ত খুন হন ৩ হাজার ২৮২জন। সব মিলে ১৫ বছর ৮ মাসে সারা দেশে খুন হন ৬০ হাজার ৩৭ জন।
ডাকাতির পরিসংখ্যান : ১৫ বছর ৮ মাসে ডাকাতীর ঘটনা ঘটে ৭ হাজার ৫৯৯ টি। এর মধ্যে ২০০৯ সালে ৭৬৪টি, ২০১০ সালে ৬৫৬টি, ২০১১ সালে ৬৫০টি, ২০১২ সালে ৫৯৩টি, ২০১৩ সালে ৬১৩টি, ২০১৪ সালে ৬৫১টি, ২০১৫ সালে ৪৯১টি, ২০১৬ সালে ৪০৮টি, ২০১৭ সালে ৩৩৬টি, ২০১৮ সালে ২৬২টি, ২০১৯ সালে ৩৫০টি, ২০২০ সালে ৩০২টি, ২০২১ সালে ৩০৮টি, ২০২২ সালে ৪০৬টি, ২০২৩ সালে ৩১৯টি ও ২০২৪ সালের আগষ্ট পর্যন্ত ৮ মাসে ডাকাতির ঘটনা ঘটে ৪৯০টি।

দস্যুতার পরিসংখ্যান : ১৫ বছর ৮ মাসে দস্যুতার ঘটনা ঘটে ১৬ হাজার ৪৫ টি। এর মধ্যে ২০০৯ সালে ১২৯৮টি, ২০১০ সালে ১০৫৯টি, ২০১১ সালে ১০৬৯টি, ২০১২ সালে ৯৬৪টি, ২০১৩ সালে ১০২১টি, ২০১৪ সালে ১১৫৫টি, ২০১৫ সালে ৯৩৩টি, ২০১৬ সালে ৭২২টি, ২০১৭ সালে ৬৫৭টি, ২০১৮ সালে ৫৬২টি, ২০১৯ সালে ৮৯৬টি, ২০২০ সালে ৯৭৮টি, ২০২১ সালে ৯৭১টি, ২০২২ সালে ১১২৮টি, ২০২৩ সালে ১২২৭টি ও ২০২৪ সালের আগষ্ট পর্যন্ত ৮ মাসে দস্যুতার ঘটনা ঘটে ১৪০৫টি।

সিঁধেল চুরির পরিসংখ্যান : ১৫ বছর ৮ মাসে সিঁধেল চুরির ঘটনা ঘটে ৪২ হাজার ৭৬৬ টি। এর মধ্যে ২০০৯ সালে ৩৪৫৬টি, ২০১০ সালে ৩১০১টি, ২০১১ সালে ৩১৩৪টি, ২০১২ সালে ২৯২৭টি, ২০১৩ সালে ২৭৬২টি, ২০১৪ সালে ২৮০৯টি, ২০১৫ সালে ২৪৯৭টি, ২০১৬ সালে ২২১৩টি, ২০১৭ সালে ২১৬৩টি, ২০১৮ সালে ২১৩৮টি, ২০১৯ সালে ২৪৩৯টি, ২০২০ সালে ২৫৩৩টি, ২০২১ সালে ২৬৪৫টি, ২০২২ সালে ২৮১০টি, ২০২৩ সালে ২৪৮৩টি ও ২০২৪ সালের আগষ্ট পর্যন্ত ৮ মাসে সিঁধেল চুরির ঘটনা ঘটে ২৬৫৬টি।

চুরির পরিসংখ্যান : ১৫ বছর ৮ মাসে চুরির ঘটনা ঘটে ১ লাখ ২৫ হাজার ৩৩১ টি। এর মধ্যে ২০০৯ সালে ৯১৭১টি, ২০১০ সালে ৮৫২৯টি, ২০১১ সালে ৮৮৭৩টি, ২০১২ সালে ৮৫৯৮টি, ২০১৩ সালে ৭৮৮২টি, ২০১৪ সালে ৭৬৬০টি, ২০১৫ সালে ৬৮১৯টি, ২০১৬ সালে ৬১১০টি, ২০১৭ সালে ৫৮৩৩টি, ২০১৮ সালে ৫৫৬০টি, ২০১৯ সালে ৬৮৮০টি, ২০২০ সালে ৯৫৯১টি, ২০২১ সালে ৮৪৯৮টি, ২০২২ সালে ৯৫৯১টি, ২০২৩ সালে ৯৪৭৫টি ও ২০২৪ সালের আগষ্ট পর্যন্ত ৮ মাসে চুরির ঘটনা ঘটে ৮৬৫২টি।
উল্লেখযোগ্য হত্যাকাণ্ড : ২০১০ সালের ৮ অক্টোবর নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার বনপাড়া শহরে বিএনপির বিক্ষোভ কর্মসূচি চলাকালে বড়াইগ্রাম উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা সানাউল্লাহ নূর বাবুকে পুলিশের সামনেই পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ঘটনার পরদিন তার স্ত্রী মহুয়া নূর কচি বাদী হয়ে বড়াইগ্রাম থানায় ২৭ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন।

সাভারের আমিনবাজারে ২০১১ সালের ১৭ জুলাই শবেবরাতের রাতে পিটিয়ে হত্যা করা হয় ছয় ছাত্রকে। তারা হলোÑ ধানমন্ডির ম্যাপল লিফ স্কুলের এ লেভেলের ছাত্র শামস রহিম, মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক শ্রেণির দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ইব্রাহিম খলিল, বাঙলা কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র তৌহিদুর রহমান পলাশ, তেজগাঁও কলেজের ব্যবস্থাপনা প্রথম বর্ষের ছাত্র টিপু সুলতান, মিরপুরের বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজির (বিইউবিটি) বিবিএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র সিতাব জাবীর মুনিব এবং বাঙলা কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র কামরুজ্জামান কান্ত। আলোচিত ওই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মামলা হলে ১৩ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও ১৯ জনকে যাবজ্জীবন সাজা এবং ২৫ জনকে খালাস দেওয়া হয়।

২০১১ সালের ১ নভেম্বর নরসিংদীর জনপ্রিয় পৌর মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা লোকমান হোসেনকে জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় নিহতের ছোট ভাই মো. কামরুজ্জামান কামরুল বাদী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের তৎকালীন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর ভাই সালাউদ্দিন আহমেদ বাচ্চুকে প্রধান করে ১৪ জনের নামে মামলা করেন। পুলিশ মামলাটির চার্জশিট দিলেও আজও বিচার শেষ হয়নি। একই বছরের ১৪ ডিসেম্বর যশোর বিএনপির সভাপতি নাজমুল ইসলামকে অপহরণ করে নৃশংসভাবে খুন করা হয়। পরদিন গাজীপুর থেকে তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

২০১২ সালের ৫ মার্চ গুলশানে গুলিবিদ্ধ হন ঢাকায় সৌদি দূতাবাসের কর্মকর্তা খালাফ আল আলি। পরদিন ভোরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। খালাফ হত্যার ঘটনায় ৭ মার্চ গুলশান থানায় মামলা করে পুলিশ। একই বছরের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৪ মামলার রায়ে পাঁচজনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। নিম্ন আদালতের রায়ের পর আসামিদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদনের (ডেথ রেফারেন্স) জন্য হাইকোর্টে এলে আসামিরা আপিল করেন। শুনানি শেষে ২০১৩ সালের ১৮ নভেম্বর হাইকোর্ট রায় দেন। রায়ে এক আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়। তিন আসামির মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। এক আসামিকে খালাস দেওয়া হয়। ২০১৯ সালের ৩ মার্চ আসামি সাইফুল ইসলাম মামুনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় গাজীপুরের কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে।

২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর বিএনপির নেতৃত্বে অবরোধ কর্মসূচি চলাকালে শিবিরকর্মী ভেবে পুরান ঢাকার দর্জি বিশ্বজিৎ দাসকে কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করেন ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা। এ ঘটনার সিসি ফুটেজ পর্যালোচনা করে আসামিদের শনাক্ত করে পুলিশ। এ ঘটনায় হত্যা মামলা হয়। ২০১৮ সালে এ মামলায় আটজনকে ফাঁসি ও ১৩ জনকে যাবজ্জীবন সাজা দেন আদালত। কিন্তু সেই রায় আজও বাস্তবায়ন হয়নি। আসামিদের অনেকেই গ্রেপ্তার হয়নি।

২০১৩ সালের ২৯ জুলাই গুলশানে শপার্স ওয়ার্ল্ড নামে একটি বিপণিবিতানের সামনে যুবলীগ নেতা রিয়াজুল হক মিল্কীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরদিন তার ছোট ভাই বাদী হয়ে গুলশান থানায় ১১ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতপরিচয় আরও চার-পাঁচজনকে আসামি করে মামলা করেন। আজও সেই হত্যা মামলার বিচার হয়নি।

মিল্কী হত্যাকাণ্ডে জড়িত হিসেবে অন্যতম সন্দেহভাজন আসামি মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপুকেও একই কায়দায় ২০২৪ সালের ২৪ মার্চ গুলি করে হত্যা করা হয়। রাজধানীর শাহজাহানপুরে ওই হামলার সময় প্রীতি নামে এক কলেজছাত্রীও নিহত হন সন্ত্রাসীদের গুলিতে। ওই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পুলিশ আদালতে চার্জশিট দিলেও আসামিরা জামিনে ছাড়া পেয়ে যায়।

২০১৪ সালের ১৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জে র‌্যাবের নেতৃত্বে আইনজীবীসহ সাতজনকে তুলে নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। ওই হত্যাকাণ্ড দেশ-বিদেশে ব্যাপক আলোড়ন তোলে। এ ঘটনায় আওয়ামী লীগ নেতা নুর হোসেনসহ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে জড়িত হিসেবে নারায়ণগঞ্জের সাবেক এমপি শামীম ওসমানের নামও আসে। সাত খুনের এ ঘটনায় র‌্যাব-১১-এর সিও লে. কর্নেল তারেক সাঈদকে প্রথমে বরখাস্ত এবং পরে গ্রেপ্তার করা হয়।

২০১৬ সালে অজ্ঞাত অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিজ বাড়িতে খুন হন গাইবান্ধা-১ আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য মনজুরুল ইসলাম লিটন। পরে চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ড তদন্ত করতে গিয়ে ওই আসনের জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য ডা. আবদুল কাদের খানের সংশ্লিষ্টতা পায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বিচারে আবদুল কাদির খানসহ সাতজনকে ফাঁসির দণ্ড দেওয়া হয়। সম্প্রতি কারা হেফাজতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আবদুল কাদের মারা যান। অন্য আসামিরা এখনও জেলে।

২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করে বুয়েট ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মী। আবরার হত্যার ঘটনায় ১৯ জনকে আসামি করে নিহতের বাবা বরকত উল্লাহ ঢাকার চকবাজার থানায় মামলা করেন। ওই হত্যা মামলায় ২০ জনের মৃত্যুদণ্ড আর পাঁচজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দিয়েছিলেন ঢাকার একটি আদালত।

আওয়ামী লীগের আমলে বিএনপি নেতা ইলিয়াছ আলী, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর ও বিএনপি নেতা চৌধুরী আলমকে গুম করা হয়। তাদের আর খোঁজ মেলেনি। এ দুটি হত্যাকাণ্ডে রাষ্ট্রীয় একটি গোয়েন্দা সংস্থার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে।

দায়ী বিচারহীনতার সংস্কৃতি : আওয়ামী লীগের টানা তিন মেয়াদের শাসনামলে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বরাবরই থেকেছে নিয়ন্ত্রণের বাইরে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বিশেষ করে পুলিশ দলীয় বাহিনীতে পরিণত হওয়ায় দেশে ওই সময় পেশাদার অপরাধীদের দৌরাত্ম্য ছিল অনেক বেশি। বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে অনেক ক্ষেত্রে মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নিয়েছে। ঘটেছে নৃশংস হত্যাকাণ্ড। দেশের অপরাধ ও সমাজ-বিশ্লেষকদের বক্তব্যে এমন অভিমত উঠে এসেছে। তারা বলছেন, আওয়ামী লীগের ১৫ বছর আট মাসের শাসনকালে ক্ষমতায় টিকে থাকতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। নৃশংস হত্যার ঘটনায় অনেক মামলার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ছিল পুলিশের ওপর। এর ফলে পুলিশ আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে পেশাদারত্ব দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরাও থেকেছেন জবাবদিহিতার বাইরে। তারা দল ও ব্যক্তিস্বার্থে বিরোধী দল-মত, দমন-পীড়নে বেশি সময় পার করেছেন। অনেক ক্ষেত্রে তারা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের নানা কৌশলে হত্যার মতো ঘটনায় জড়িয়ে পড়তেও দেখা গেছে।

বিশ্লেষকদের মতে, পুলিশকে নিজের পেশার বাইরে গিয়ে সরকারের গুণকীর্তন করা, কোনো ঘটনা তদন্তের নামে মিডিয়ায় মনগড়া গালগল্প প্রচার এবং নিরপরাধ মানুষকে ফাঁসানোর জাল বিস্তারে মনোযোগী থাকতে দেখা গেছে। বাস্তবে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে তাদের সক্রিয় ভূমিকা দেখা যায়নি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, একটি দেশে প্রতিবছর গড়ে চার হাজারের বেশি খুন হওয়া আইনশৃঙ্খলার স্বাভাবিক পরিস্থিতির পরিপন্থি বলা যায়। আওয়ামী লীগের শাসনামলে বছরে গড়ে এতো খুন হওয়া মানে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেননি। গুম, অপহরণ, ধর্ষণসহ অন্যান্য অপরাধও ছিল ভয়াবহ।

তিনি আরও বলেন, যখন দেশে খুন, ডাকাতি, চুরিসহ অন্যান্য অপরাধ বেড়ে যায় তখন দেখা যায়, অপরাধীরা কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় থেকে এসব অপরাধ করছে। অনেক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আমরা দেখেছি রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের সংশ্লিষ্টতা। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের সময় অনেক চাঞ্চল্যকর হত্যার ঘটনায় দলটির নেতাকর্মীরা জড়িত ছিল। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আবার কোনো কোনো হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মামলা হলেও আসামি গ্রেপ্তার হয়নি। যখন কোনো অপরাধী অপরাধ করে রাজনৈতিক আশ্রয়ে ছাড় পেয়ে যায় তখন অপরাধের মাত্রা আরও বাড়তে থাকে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবিএম নাজমুস সাকিব বলেন, ‘বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতার কারণে আমাদের দেশে অপরাধের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না। অপরাধীরা মনে করে যে সে যতই অপরাধ করুক তার কোনো সাজা হবে না। বিশেষ করে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়।’ তিনি বলেন, ‘অনেক হত্যা মামলায় আমরা বিচারের দীর্ঘসূত্রতা দেখেছি, আবার কোনো কোনো হত্যা মামলায় দ্রুত বিচার হয়েছে গুরুত্ব এবং প্রোফাইল বিবেচনায়। এ জায়গা থেকে আমাদেরকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমি মনে করি, হত্যার মতো গুরুতর ঘটনার মামলাগুলো বিচারে পৃথক আদালত গঠন করা সময়ের দাবি। তাতে করে প্রতিটি হত্যার ঘটনায় দ্রুত সময়ের মধ্যে বিচার নিশ্চিত করা যাবে।

 

তো কা / এনজি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *