সারা বিশ্বে আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের খবর। এর আগেও দুই দেশের মধ্যে একাধিকবার যুদ্ধ হয়েছে এবং বর্তমান সময়ে যে কারণে দুই দেশের মধ্যে এই সম্পর্কের অবনমন, এর চেয়ে বেশি অবনমনের ঘটনাও ঘটেছে। সেসব যুদ্ধের কোনোটাই এত উত্তেজনা ছড়াতে পারেনি, যতটা না এবার হচ্ছে।
দুই দেশের মধ্যে সর্বশেষ বড় সংঘাতের ঘটনাটি ঘটে ১৯৮৯ সালে কার্গিল যুদ্ধে। এপর্যন্ত যতবারই দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে, এর পেছনের কারণগুলো ছিল একই, কাশ্মির। এর মধ্যে জল অনেকদূর গড়িয়েছে।
নব্বই দশকের শেষে ভারতকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে যখন পাকিস্তান সফলভাবে তার পরমাণু অস্ত্রের পরীক্ষা চালায়, এরপর থেকেই ধারণা করা যাচ্ছিল যে দক্ষিণ এশিয়ার এই দুই পরমাণু শক্তিধর দেশের মধ্যে ভবিষ্যতে কাশ্মির নিয়ে উত্তেজনা অজানা নানারকম শঙ্কার জন্ম দিতে পারে।
এবারের ঘটনাটিও অতীতের ঘটনাগুলোর মতোই, তবে তফাত হচ্ছে কাশ্মিরের পেহেলগামের হামলাটিতে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছিল নিরীহ পর্যটকদের, যেখানে ২৬ জন প্রাণ হারান। তবে এটাও নিশ্চয়ই আমাদের স্মরণে রয়েছে যে ২০০৮ সালেও মুম্বাইয়ে জঙ্গি হামলায় ১৬৬জন নিহত হয়েছিলেন, যারা সবাই বেসামরিক লোক।
…শুধুই কি ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিবেচনা এখানে মুখ্য ভূমিকা হিসেবে কাজ করেছে, নাকি এর পেছনে আন্তর্জাতিক রাজনীতিরও কার্যকর ভূমিকা রয়েছে, সেসব বিষয়ও প্রসঙ্গক্রমে এসে যায়।
সে সময়ও সেসব হামলার পেছনে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে পাকিস্তানের জঙ্গিগোষ্ঠী, যারা এই হামলা পরিচালনা করেছিল, তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করার জন্য পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক শাসক পারভেজ মোশাররফের সরকারকে দায়ী করা হয়েছিল।
অতীতের এসব দৃষ্টান্ত থেকে তাই এবার প্রশ্ন উঠাই স্বাভাবিক যে উত্তেজনা নিবারণের অনেক পথ থাকতে, এমনকি কূটনৈতিক উপায়ে সমস্যা সমাধানের পথ এড়িয়ে ভারতের দিক থেকে কেন পাকিস্তানে হামলার প্রস্তুতি গ্রহণ করা হলো। এর পেছনে কারণ একটাই, আর সেটা হলো এই সংঘাতকে বাস্তবিক অর্থেই রাজনীতিকরণ করা হয়ে গেছে।
শুধুই কি ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিবেচনা এখানে মুখ্য ভূমিকা হিসেবে কাজ করেছে, নাকি এর পেছনে আন্তর্জাতিক রাজনীতিরও কার্যকর ভূমিকা রয়েছে, সেসব বিষয়ও প্রসঙ্গক্রমে এসে যায়। খুব বেশি নয়, আমরা যদি কিছুটা পেছনে তাকাই, তাহলে দেখব পেহেলগামের হামলার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে পশ্চিমা দেশগুলো সেসময় ভারতের প্রতি তাদের সহানুভূতি ব্যক্ত করেছিল।
এক্ষেত্রে মার্কিন মিত্র ইসরায়েল একধাপ এগিয়ে ‘ভারতের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে’ বিষয়টির উল্লেখ করে তাদের সমরসজ্জার প্রতি প্রকারান্তরে সমর্থন ব্যক্ত করে। অন্যদিকে ইরান এবং তুরস্কের মতো দেশগুলো পরোক্ষভাবে পাকিস্তানের অবস্থানের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করতে দেখা যায়।
পেহেলগামের হামলার জন্য ভারত সরকারের পক্ষ থেকে একতরফাভাবে পাকিস্তান সরকারকে দোষারোপ করা হলে এবং পাকিস্তানের পক্ষ থেকে এর দায় অস্বীকার করা হলে অনেক দেশের পক্ষ থেকে কূটনৈতিক পন্থায় উত্তেজনা প্রশমনের অনুরোধ জানানো হলেও ভারতের এই সমরসজ্জা পাকিস্তানকেও যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে প্রভাবিত করে।
এক্ষেত্রে পাকিস্তানের জন্য সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গাটি হচ্ছে প্রতিবেশী চীন। যদিও উভয় দেশের সাথেই চীনের সীমান্ত রয়েছে, সম্পর্কের ইতিহাস বিবেচনায় পাকিস্তানের সাথে চীনের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বেশ পুরোনো এবং একইভাবে ভারত-চীন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্রমাবনতির প্রেক্ষাপটে সামরিক শক্তিতে পিছিয়ে থাকলেও ভারতের চেয়ে খুব একটা পিছিয়ে নেই পাকিস্তান।
এখানে দুই দেশের মধ্যকার শক্তির পার্থক্যের সমতা এনে দিয়েছে তাদের উভয়েরই পারমাণবিক সক্ষমতা, অর্থাৎ উভয়েই উভয়ের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো লক্ষ্যবস্তু করে হামলা চালাতে সক্ষম। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বাস্তববাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে আমরা দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে কিংবা শক্তিধর প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে পারমাণবিক এই সক্ষমতা অর্জনকে সর্বাত্মক যুদ্ধের ক্ষেত্রে নিবারকের ভূমিকা হিসেবে কাজ করতে দেখি, যা অনেক বছর ধরে হয়েও এসেছে।
তবে ভারত-পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক সময়ের এই উত্তেজনা প্রশমনে এই ‘নিবারক তত্ত্ব’ কতটুকু কাজ করতে সক্ষম, সেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। প্রথমে হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করা, পরবর্তীতে সিন্ধুর জলচুক্তি এবং পাকিস্তানি নাগরিকদের ভারতের ভিসা বাতিল করা, পাকিস্তানের কূটনীতিকদের ভারত থেকে বহিষ্কার করা এবং বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার জবাবে একইভাবে ভারতীয়দের জন্য পাকিস্তানের আকাশসীমা বন্ধ করে দেওয়া, ভারতীয় কূটনীতিকদের পাকিস্তান থেকে বহিষ্কার করা এবং বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার বাইরেও চলতে থাকে একেক অপরকে লক্ষ্য করে উভয় দেশের সমর প্রস্তুতি।
সেই সাথে নিয়ন্ত্রণ রেখায় প্রায় প্রতিদিনই দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি গোলাগুলি। সবশেষে ভারতের পক্ষ থেকে ৬ মে ২০২৫ মধ্যরাতে পাকিস্তানের ৯টি লক্ষ্যবস্তুতে ২৪টি হামলা পরিচালনা করা। এর জবাবে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে ভারতের কয়েকটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করা এবং ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মির সীমান্তে হামলা। উভয় দেশের এই হামলায় বেসামরিক নাগরিকসহ ইতিমধ্যে ৫০ জনের অধিক প্রাণ হারিয়েছেন বলে জানা যায়।
বর্তমান বাস্তবতায় এই সংঘাতের এধরনের বিস্তৃতির পেছনের কারণগুলো যতটা না ভূ-রাজনৈতিক বা নিরাপত্তাজনিত, এরচেয়ে অনেক বেশি সরকারগুলোর রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা।
স্পষ্টতই বলা যেতে পারে যে, ভারতের শাসকদল বিজেপি সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন দুর্নীতি এবং অব্যবস্থাপনার জন্য রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা অবস্থায় রয়েছে, তাদের কট্টর সমর্থকদের পক্ষ থেকেও নিজেদের শক্তিমত্তা জানান দেওয়ার চাপ রয়েছে সেই সাথে পেহেলগামের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো যদি সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, বিষয়টি নরেন্দ্র মোদির জন্য বেশ ঝামেলার হবে।
এসব বিবেচনা থেকেই নিজেদের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ধরে রাখতে ভারতকে এমন কিছু করতে হচ্ছে, যা থেকে এটা মনে হয় যে এই মুহূর্তে পাকিস্তানকে কোনোভাবেই ছাড় দিতে চাইছে না ভারত। ইতিমধ্যে ভারত সরকারের পক্ষ থেকেও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে ৬ মে ২০২৫ মধ্যরাতের হামলার বিরুদ্ধে যদি পাকিস্তান পাল্টা পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে বিষয়টি এখানেই শেষ হয়ে যাবে।
এই যুদ্ধ এখনো পর্যন্ত সর্বাত্মকভাবে শুরু না হলেও প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটানসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জন্য বাণিজ্যিক সম্পর্কের বিচারে একধরনের সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে
ভারতের মতো একই বাস্তবতা পাকিস্তানের জন্যও প্রযোজ্য। ৭ মে ২০২৫ তাদের সরকারের পক্ষ থেকে দেশটির সেনাবাহিনীকে যেকোনো পদক্ষেপ গ্রহণের স্বাধীনতা দিয়ে দেওয়া হয়েছে সেদিন রাতেই কাশ্মিরে ভারতীয় সেনাদের লক্ষ্য করে ব্যাপক গুলিবর্ষণ করে তারা, এতে একজন ভারতীয় সেনা নিহতের খবর পাওয়া গেছে।
সুতরাং এই পাল্টাপাল্টি হামলা বন্ধ করতে হলে প্রয়োজন কোনো একপক্ষকে সংযম প্রদর্শন করা, যা এই মুহূর্তে লক্ষ্যণীয় নয়। ভারতের ভেতর বিষয়টিকে যেমনভাবে রাজনীতিকরণের মধ্য দিয়ে এই জায়গায় নিয়ে আসা হয়েছে, একইভাবে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর ক্রমবর্ধমান চাপ দেশটির বেসামরিক সরকারকে ভারত বিরোধী অবস্থানে অটল থাকতে বাধ্য করছে।
এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতা কতটা কাজে আসবে, সেটা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে, কেননা ভারত এবং পাকিস্তানের সাথে যথাক্রমে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের সম্পর্কের গভীরতায় এই দুটো দেশের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ এবং সংকট সমাধানে তারা কতটা আন্তরিক, বিষয়টি এখনো স্পষ্ট নয়।
এই যুদ্ধ এখনো পর্যন্ত সর্বাত্মকভাবে শুরু না হলেও প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটানসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জন্য বাণিজ্যিক সম্পর্কের বিচারে একধরনের সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে, সর্বাত্মক যুদ্ধ সর্বাগ্রে ব্যাপক শরণার্থী সংকট সৃষ্টি ছাড়াও নিঃসন্দেহে বেসামরিক নাগরিকসহ ব্যাপক প্রাণহানি সৃষ্টি করবে, আর কোনো একপক্ষের ধৈর্যচ্যুতির ফলে যদি পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার ঘটে, তবে সেটা হবে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বিপর্যয়কর পরিস্থিতি।
যুদ্ধ কোনোভাবেই কাম্য নয়, বিশেষ করে এই দুই দেশের মধ্যকার যুদ্ধ কোনোভাবেই জয়-পরাজয় মীমাংসা করবে না। বর্তমান বাস্তবতায় দুই পক্ষের মধ্যে দ্রুত কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় তৃতীয় পক্ষের জন্য অপেক্ষা না করাই শ্রেয়।
অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়