নিজস্ব প্রতিবেদক
০৪ মে ২০২৫
রোববার দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষ্যে সম্পাদক পরিষদ আয়োজিত এক আলোচনা সভায় সম্পাদকগণ বলেছেন, এটা স্বীকার করতেই হবে যে, পরিস্থিতি আগের চেয়ে অনেক উন্নতি ঘটেছে। সম্পাদক পরিষদের উদ্যোগে এই আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকরা অংশ নেন।
সম্পাদক পরিষদের সভাপতি ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনামের সভাপতিত্বে ও পরিষদের সাধারণ সম্পাদক বনিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদের সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, জনসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, মানবজমিনের সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী, নিউ এইজের সম্পাদক নুরুল কবির, কালের কন্ঠের সম্পাদক ও জাতীয় প্রেসক্লাব সভাপতি হাসান হাফিজ প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান, দৈনিক ইনকিলাবের সম্পাদক এএমএম বাহাউদ্দিন, সমকালের সম্পাদক শাহেদ মুহাম্মদ আলীসহ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকরা উপস্থিত ছিলেন।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে গণমাধ্যমের সম্পর্ক ইতিবাচক হবে প্রত্যাশা করে জাতীয় নগারিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, যে মুক্ত গণমাধ্যমের প্রতিশ্রুতি আমরা সবাই দিচ্ছি, সেটি আরও কীভাবে কার্যকর করা যায়, সেই বিষয়ে নিজেদের মধ্যে খোলামেলা আলোচনা করে রূপরেখা তৈরি করতে পারলে আমাদের জন্য ভালো হবে। গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সুপারিশ দ্রুত আসা উচিত। আমি মনে করি, সেই সংস্কারের রূপরেখাগুলো এলে এবং বাস্তবায়ন হওয়া শুরু করলে আমরা বলতে পারবো, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরে গণমাধ্যমের পরিবর্তনটা দৃশ্যমান হচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা বিশ্বাস করি, গণতন্ত্র চর্চার জন্য, মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য, মুক্ত গণমাধ্যম অতি গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড। ফলে মত প্রকাশের অধিকার হরণ থেকেই আমাদের আন্দোলনের যাত্রা শুরু। তিনি বলেন, মুক্ত গণমাধ্যমের প্রত্যাশা ও আকাঙ্ক্ষায় দীর্ঘদিন ধরে গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো লড়াই করেছে।
তিনি আরও বলেন, মিডিয়া এবং ফ্যাসিজমের সম্পর্ক বিগত সময়গুলোতে কী ছিল এবং মিডিয়ার ভেতরে যে ফ্যাসিজম প্রবেশ করেছে, সেখান থেকে মিডিয়াকে আমরা কীভাবে বের করতে পারবো, সেই বিষয়ে স্পষ্ট রূপরেখা প্রয়োজন। কারণ আমরা দেখছি, মিডিয়া এবং ফ্যাসিজমের যে সম্পর্ক বিগত সময়ে ছিল, সেই সম্পর্ক থেকে এবং আদর্শিক আধিপত্যের জায়গা থেকে যদি মিডিয়া বের না হয়, তাহলে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরবর্তীকালে আমরা যে মুক্ত গণমাধ্যমের প্রত্যাশা করি এবং জনগণের মিডিয়ার প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গা সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত হবে না। মিডিয়ার সুশাসনের বিষয়টি মিডিয়ার ভেতর থেকেই নিশ্চিত করা উচিত। সেই বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত।
গত বছরের বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস পালনের পরিবেশ আর ২০২৫ এর পরিবেশে ভিন্নতা রয়েছে মন্তব্য করেছেন সম্পাদক পরিষদের সহ-সভাপতি ও নিউ এজ-এর সম্পাদক নুরুল কবির। কারন হিসেবে তিনি বলেন, দেশের সরকার প্রধানদের উপর অনেক কিছু নির্ভর করে। রাজনীতিবিদদের উপর সংবাদ কর্মীদের কাজের স্বাধীনতা নির্ভর করে। নানা প্রতিকুলতার মধ্যে কাজ করতে গিয়ে সংবাদকর্মীদের অনেক ক্ষেত্রে স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হয়।
বিগত সরকারের বিষোদগার করে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, বিদেশে বসে শেখ হাসিনা নানা বক্তব্য দিচ্ছেন। সেগুলো প্রচার হচ্ছে, কিন্তু নিয়ন্ত্রণের ব্যাবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। এগুলো নিয়ন্ত্রণের যোগ্য কিনা জানতে চান তিনি। এসব প্রচার নিয়ন্ত্রণ করা হলে স্বাধীনতা খর্ব হবে কিনা তাও ভাববার বিষয় বলে মনে করেন তিনি।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, গনমাধ্যমের স্বাধীনতা মানে শর্তহীন স্বাধীনতা নয়। অন্যের স্বাধীনতা ক্ষুন্ন না করে স্বাধীনতার চর্চা না হলে সেটা হবে স্বেচ্ছাচারিতা। গনমাধ্যমের একটা নীতিমালা থাকা প্রয়োজন বলেও মনে করেন তিনি। তবে গসরকার যেন গনমাধ্যমের গলা টিপে না ধরতে পারে সে ব্যবস্থা থাকতে হবে। তিনি বলেন, আমরা একটা ভয়হীন সমাজ গড়তে চাই। রাষ্ট্র এমন আইন করতে পারবে না যাতে সাংবাদিকদের কণ্ঠ রোধ হয়।
গণমাধ্যম ছাড়া গণতন্ত্র চর্চা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন দৈনিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী। তিনি বলেন, আমাদের কথা বলতে দিতে হবে, লিখতে দিতে হবে, প্রশ্ন করতে দিতে হবে। তাহলেই গণমাধ্যম মুক্তির স্বাদ পাবে। তিনি বলেন, যে দেশে প্রশ্ন করার জন্য সাংবাদিকের চাকরি যায়, সেই দেশে মুক্ত গণমাধ্যম দিবস পালন করছি। খুব অবাক লাগে, আমি বিস্মিত হই। জানি না আমি কাকে দায়ী করবো। আমি কি সরকারকে দায়ী করবো, না, মালিককে দায়ী করবো, না, সাংবাদিক ইউনিয়ন কী করেছে। আমাদের সম্পাদক পরিষদ, যেটাতে আমি প্রতিষ্ঠাকালীন থেকে আছি, ট্রেজার হিসেবে আছি। আমি মনে করি আমরাও ব্যর্থ হয়েছি। যাই হোক আত্মসমালোচনা আমাদের দরকার যে, আমরা কতটুকু করতে পেরেছি। তিনি আরও বলেন, তবে এটা স্বীকার করতেই হবে যে, পরিস্থিতি উন্নতি হয়েছে অনেকখানি। একবছর আগে যে অবস্থা ছিল, সেই অবস্থা এখন আর নেই। অনেকখানি পাল্টেছে। তবে আমার হতাশ হচ্ছি-বেশ কিছু অ্যাকশানের কারণে।
সাংবাদিকদের আরো দায়িত্বশীল হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ও কালের কণ্ঠের সম্পাদক কবি হাসান হাফিজ। তিনি বলেন, ফিলিস্তিনে ১৮ মাসে ২০০ শতাধিক সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪২ জন কর্তব্যরত অবস্থায় মারা গেছেন। বাংলাদেশেও জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সাংবাদিকদের রক্তধারা রয়েছে। দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধেও সাংবাদিকরা প্রাণ দিয়েছেন। সুতরাং গণমানুষের মুক্তির জন্য আমরা আছি। স্বাধীনতা মানে স্বেচ্ছাচারিতা নয়। আমরা যেন দায়িত্বশীল হই, আমরা যেন গণআস্থা ফিরিয়ে আনতে পারি। সে চেষ্টা আমাদের করতে হবে। তিনি আরো বলেন, দীর্ঘ ফ্যাসিবাদের কবলে পড়ে অনেক গণমাধ্যম বন্ধ হয়েছে, অনেকে ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছি, সেগুলো আমরা ভবিষ্যতে চাইব না। নতুন রাজনৈতিক দল যারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবে জনগণের সমর্থন নিয়ে আমরা আশা করব তারা মুক্ত গণমাধ্যম নিশ্চিত করবে।
সভাপতির বক্তব্যে ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেন, আজকে আমাদের এটা উপলব্ধি করতে হবে আমরা গণমাধ্যম জনগণের সেবার কাজে নিয়োজিত। আমরা দেশপ্রেমিক, সমাজকে উন্নত করতে চাই, বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাস করি, মত প্রকাশে বিশ্বাস করি এবং সমস্ত কাজ সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যেই। তবে এটা সত্য আমাদের গণমাধ্যম মুক্ত না । শেখ হাসিনা রিজিম জনধিককৃত হয়েছিল তার অন্যতম কারণ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ছিল না।
জা ই / এনজি