মতামত
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে আমরা লক্ষ্য করছি যে, সামাজিক বন্ধন ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে। সমাজের ভেতরে যে ঐক্য, পারস্পরিক আস্থা ও সহযোগিতার ঐতিহ্য ছিল, তা এখন নানা কারণে ভেঙে যাচ্ছে। এই অবক্ষয়ের পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, সামাজিক বিভাজন, অর্থনৈতিক বৈষম্য, আস্থার সংকট এবং সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের সমষ্টিগত প্রভাব।
রাজনীতির প্রভাব এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, আজ গ্রামগঞ্জের হাটবাজার, উপাসনালয় এমনকি স্কুল-কলেজও দলীয় প্রভাবের বাইরে নয়। কোথাও কোনো উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হলেও সেখানে দলীয় আনুগত্য হয়ে উঠছে মূল মাপকাঠি। ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে বাড়ছে অবিশ্বাস, সন্দেহ এবং শত্রুতা—‘শত্রুতার সংস্কৃতি (culture of enmity)’ তৈরি হয়েছে যা সামাজিক সহাবস্থানকে দুর্বল করে তুলেছে।
সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, যখন কোনো সমাজে রাজনৈতিক পরিচয় মানুষের মূল চিন্তা, বন্ধুত্ব, পেশা এবং পারিবারিক সম্পর্ক নির্ধারণের নিয়ামক হয়ে ওঠে, তখন সামাজিক সাম্য, সহানুভূতি ও জাতীয় ঐক্য দুর্বল হয়ে যায়। আমরা দেখতে পাচ্ছি, যারা ভিন্ন মত পোষণ করে তাদের প্রতি অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সামাজিক সম্পর্কের জাল, যা একসময় পারস্পরিক সহনশীলতা ও সমঝোতার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছিল, এখন তা সন্দেহ আর প্রতিযোগিতার মেরুকরণে হেঁটে যাচ্ছে।
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ভেতরেও এই বিভাজনের ছায়া পড়েছে। আগে যেখানে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ছিল নৈতিকশিক্ষা, সহমর্মিতা এবং সম্প্রীতির কেন্দ্র, এখন অনেক ক্ষেত্রে তা রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির মঞ্চে পরিণত হয়েছে। ধর্মীয় বক্তারা কখনো কখনো দলীয় রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচারে ব্যবহার হচ্ছেন। ফলে ধর্মও আর বিভাজনের ঊর্ধ্বে থাকছে না। একইসঙ্গে ধর্মীয় রাজনীতির উত্থান নতুনভাবে সামাজিক উত্তেজনা তৈরি করছে, যেখানে সহাবস্থানের ঐতিহ্য প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে।
শিক্ষিত সমাজের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ এবং পেশাগত প্রতিষ্ঠানগুলো, যেগুলো একসময় মুক্ত চিন্তার চর্চাকেন্দ্র ছিল, আজ অনেক জায়গায় দলীয় আনুগত্যের কারণে বিভক্ত।
বাংলাদেশে একটি বড় সামাজিক সংকট হলো আস্থার অভাব। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, প্রশাসন এবং বিচারব্যবস্থায় জবাবদিহিতার ঘাটতি, স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির বিস্তার মানুষের আস্থাকে ভেঙে দিয়েছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যখন জনগণের ন্যায্য প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়, তখন সমাজে হতাশা ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণ কমে যাচ্ছে, যার ফলে আমরা প্রায়ই দেখতে পাচ্ছি বিক্ষোভ, সহিংসতা এবং আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে ‘রাষ্ট্র আমাদের কিছু দেয় না’—এমন বোধ জন্ম নিচ্ছে, যা তাদের রাষ্ট্র ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে।
অর্থনৈতিক বৈষম্যও সামাজিক অবক্ষয়ের একটি প্রধান চালিকাশক্তি। দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অনেক হলেও, তার সুফল সবাই পাচ্ছে না। একটি ক্ষুদ্র শহুরে এলিট শ্রেণি দ্রুত উন্নয়ন লাভ করছে, যখন গ্রামীণ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী পেছনে পড়ে থাকছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম বা বড় শহরগুলোয় বিলাসবহুল জীবনযাপন আর গ্রামীণ এলাকায় বেকারত্ব, দরিদ্রতা এবং অবকাঠামোগত পশ্চাৎপদতা—এই বৈষম্য তরুণদের মধ্যে হতাশা ও অসন্তোষের জন্ম দিচ্ছে। তারা অনুভব করছে, তারা সমাজে মূল্যহীন এবং তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। এর ফলে সামাজিক বন্ধনগুলো দুর্বল হয়ে পড়ছে এবং অনেক সময় এদের কেউ কেউ অপরাধ, মাদকাসক্তি বা উগ্র রাজনীতির দিকে ঝুঁকে পড়ছে।
শিক্ষিত সমাজের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ এবং পেশাগত প্রতিষ্ঠানগুলো, যেগুলো একসময় মুক্ত চিন্তার চর্চাকেন্দ্র ছিল, আজ অনেক জায়গায় দলীয় আনুগত্যের কারণে বিভক্ত। শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী বা কর্মকর্তারা নিরপেক্ষ থেকে সমাজকে এগিয়ে নেওয়ার বদলে কখনো কখনো পক্ষপাতিত্ব, প্রতিশোধপরায়ণতা এবং আত্মসংশ্লিষ্টতার মধ্যে আটকে যাচ্ছেন।
সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে, যারা ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন তাদের বিরুদ্ধে মামলা, চাকরিচ্যুতি, সামাজিক বয়কট এমনকি নির্যাতন পর্যন্ত হয়েছে। এর ফলে সমাজে প্রতিশোধের সংস্কৃতি (culture of vengeance) প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, যা সামাজিক সম্পর্কের অবক্ষয়কে আরও ত্বরান্বিত করছে।
দ্রুত নগরায়ণ, পারিবারিক কাঠামোর পরিবর্তন এবং ভোগবাদী সংস্কৃতির প্রসারও সামাজিক সম্পর্ক দুর্বল করার জন্য দায়ী। যৌথ পরিবারের পরিবর্তে একক পরিবার, প্রযুক্তিনির্ভর জীবনের বিস্তার এবং আর্থিক সাফল্যের মোহ আমাদের একে অপরের প্রতি সংবেদনশীলতা কমিয়ে দিয়েছে।
অন্যদিকে, দ্রুত নগরায়ণ, পারিবারিক কাঠামোর পরিবর্তন এবং ভোগবাদী সংস্কৃতির প্রসারও সামাজিক সম্পর্ক দুর্বল করার জন্য দায়ী। যৌথ পরিবারের পরিবর্তে একক পরিবার, প্রযুক্তিনির্ভর জীবনের বিস্তার এবং আর্থিক সাফল্যের মোহ আমাদের একে অপরের প্রতি সংবেদনশীলতা কমিয়ে দিয়েছে। আগে যেখানে আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী এবং বন্ধুদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল, আজ তা অনেক ক্ষেত্রেই সামাজিক মাধ্যমে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। বাস্তব জীবনে সম্পর্কের গভীরতা কমছে, বন্ধুত্ব ও আস্থার জায়গা সংকীর্ণ হয়ে পড়ছে।
সব মিলিয়ে, বাংলাদেশে সামাজিক সম্পর্কের অবক্ষয় একটি বহুস্তরবিশিষ্ট সংকট, যেখানে রাজনৈতিক বিদ্বেষ, অর্থনৈতিক বৈষম্য, ধর্মীয় মেরুকরণ, গণমাধ্যমের অপব্যবহার এবং আস্থার সংকট মিলেমিশে কাজ করছে। এটি শুধু ব্যক্তি পর্যায়ের সমস্যা নয়, বরং জাতীয় জীবন ও ভবিষ্যতের জন্যও গভীর সংকেত বহন করছে।
এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন জাতীয় পর্যায়ে আন্তরিক আত্মসমালোচনা ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। রাজনৈতিক নেতৃত্ব, শিক্ষিত সমাজ, গণমাধ্যম, এবং নাগরিক সমাজ—সবাইকে নিজ নিজ ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসতে হবে। সমাজে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সহানুভূতি এবং সহনশীলতার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। স্কুল, কলেজ, উপাসনালয়, গণমাধ্যম ও সামাজিক সংগঠনগুলোয় সচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রম পরিচালনা করা জরুরি। এছাড়া সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং বৈষম্য দূর করার জন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
সামাজিক সম্পর্ক পুনর্গঠন ও জাতি হিসেবে ঐক্য গড়ে তুলতে কমিটি করে কিছু সংস্কার প্রস্তাব নেওয়া যথেষ্ট হবে না। আমাদের প্রয়োজন আন্তঃসম্পর্কের জাগরণ, শ্রদ্ধাশীল সংলাপ এবং আস্থাভিত্তিক সামাজিক পরিবেশ তৈরি। সামাজিক বিভাজন থাকলে রাজনৈতিক সমাধানও কার্যকর হবে না। তাই আসুন, রাজনৈতিক পরিচয় নয়, মানবিক সম্পর্ক এবং সহানুভূতিকে ভিত্তি করে আমরা নতুন এক বাংলাদেশ গড়ে তুলি, যেখানে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য এবং ভিন্নমতের মধ্যেও শ্রদ্ধাবোধ প্রতিষ্ঠিত হবে।
লেখক : অধ্যাপক, শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
জা ই / এনজি