বিশেষ সংবাদ
মোহাম্মদ জাফর ইকবাল
৩১ ডিসেম্বর ২০২৪
‘শেখ হাসিনা পালায়নি, পালায় না।’ ২২ জুলাই শেখ হাসিনা এ বক্তব্য দেয়ার ১৩ দিনের মাথায় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান তিনি। যার মধ্য দিয়ে অবসান হয় ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের দেড় দশকের জুলুম-জালিয়াতির শাসন। ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী সরকারের পতন এবং নতুন যাত্রা শুরু করা বাংলাদেশকে ২০২৪ সালের বর্ষসেরা দেশ হিসেবে নির্বাচিত করেছে প্রভাবশালী ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট। অথচ গত চারটি নির্বাচন অনেকটা একতরফাভাবে করে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রেখেছিল এই আওয়ামী লীগ। এসব নির্বাচন দেশে-বিদেশে কোথাও গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।
১৯৭১ সালের পরে ২০২৪ বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় একটি ঘটনাবহুল বছর। হত্যা, জুলুম, অত্যাচার আর সীমাহীন লুণ্ঠনে দেশ এক ভয়াবহ অন্ধকার গহ্বরে ঢুকে পড়েছিল। ১৫ বছর ধরে বিরোধী রাজনৈতিক দল থেকে সর্বস্তরের মানুষ গুম, হত্যা, নির্যাতন, লাখ লাখ মিথ্যা মামলা, বিনা বিচারে নৃশংস হত্যায় বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিল। ২০২৪-এ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে জনগণ ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের লড়াইয়ে নামে। ২০২৪ এর জুলাই-আগস্টে ইতিহাসের পাতায় হাজারো শহীদ আর আহত ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে পতন হয় আওয়ামী লীগ সরকারের। বাংলাদেশের মুক্ত আকাশে উড়তে শুরু করে বিজয়ের পতাকা।
২০২৪ সাল কেবল বাংলাদেশের জন্য নয়, সারা বিশ্বের জন্য একটা দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থিত হয়েছে বলে মনে করেন গণ-অভ্যুত্থানের পর গঠিত গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্য অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ। তিনি বলেন, ব্যাপক দুর্নীতি, লুটপাট ও জুলুমের শাসনের কারণে জনগণের মধ্যে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল। সর্বস্তরের মানুষ সেই পুঞ্জীভূত ক্ষোভ নিয়ে রাস্তায় নামলে স্বৈরশাসক যত শক্তিশালী হোক সে আর টিকতে পারে না, এটা হচ্ছে বড় শিক্ষা। স্বতঃস্ফূর্ত এই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে গণআকাংখা ও স্বপ্ন তৈরি হয়েছে, সেটা বাস্তবায়ন করাটাই হচ্ছে এখন মানুষের প্রত্যাশা। এটাকে উপেক্ষা করা যাবে না।
সূত্র মতে, ঘটনাবহুল ২০২৪ সালের শুরুতে ছিল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আগের দুই নির্বাচনের মতো এটাও ছিল পাতানো নির্বাচন। তবে প্রতিটি নির্বাচনে জেতার পদ্ধতি ছিল ভিন্ন। এর মধ্যে ২০০৮ এর নির্বাচন ছিল কথিত ওয়ান ইলেভেনের সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। যারা এই আওয়ামী লীগের আন্দোলনের ফসল ছিল। এরপরের ২০১৪ সালের নির্বাচন দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল বর্জন করেছিল। যে নির্বাচনে ১৫৩জন বিনাপ্রতিদ্বন্ধিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিল। বাকিগুলোতে এক বা দুইয়ের অধিক প্রার্থী ছিল না। ২০১৮ সালের নির্বাচন ছিল আরও জালিয়াতিপূর্ণ। যা ‘রাতের ভোট’ নামে পরিচিতি পায়। এই নির্বাচনে বিরোধীরা অংশ নিলেও সরকারি দল আগের দিন রাতেই নির্বাচন করে ফেলে। সবশেষ ২০২৪ সালে এসে হয় ‘ডামি নির্বাচন’। বিএনপিসহ ছোট-বড় অনেক দলের বর্জনের মুখে প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত এই নির্বাচনটিকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দেখাতে আওয়ামী লীগে নিজ দলের ‘ডামি’ প্রার্থী দাঁড় করায়। আওয়ামী লীগ ও ডামি আওয়ামী লীগ (দলের স্বতন্ত্ররা) মিলে ২৮০টি আসন পায়। তার আগে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের হামলা, মামলা, গ্রেপ্তার ও সাজা দিয়ে কোণঠাসা করা হয়।
টানা চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রিত্ব কুক্ষিগত করার পর জুলাইয়ের আগ পর্যন্ত অর্থনৈতিক সংকটের পাশাপাশি দোিশ বিদেশী নানা চাপের মুখে পড়তে হয় শেখ হাসিনাকে। আগের বছরের ন্যায় এবারো শুরু হয় নির্যাতনের স্টীম রোলার। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির চাপে মানুষের নাভিশ্বাস ছিল সীমাহীন। যারাই কোনো বিষয়ে প্রতিবাদ করেছে তাদের উপর নানাভাবে অত্যাচারের ঘটনা ঘটেছে। মামলাসহ গ্রেফতারও চলমান ছিল আগের বছরের ন্যায়। হামলা, মামলা, গ্রেপ্তার ও সাজা দিয়ে কোণঠাসা করা হয় বিরোধী নেতা-কর্মীদের।
বারবার একতরফা নির্বাচন ইস্যুসহ নানা কারণে সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনা যখন তুঙ্গে, তখন সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল করে ২০১৮ সালে জারি করা প্রজ্ঞাপন ২০২৪ সালের ৫ জুন অবৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। এতে পুনরায় ফিরে আসে কোটা। এর প্রতিবাদে ৬ জুন বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেন এবং ৩০ জুন পর্যন্ত সরকারকে সময় বেঁধে দেন। ১ জুলাই থেকে লাগাতার কর্মসূচি শুরু করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। যা পরে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। জুলাইয়ের মাঝামাঝি এই ছাত্র আন্দোলন বৃহৎ রূপ ধারণ করতে থাকে। তখন সরকার বীভৎস কৌশলে তা দমনের চেষ্টা করে। এর মধ্যেই শেখ হাসিনার এক বক্তব্য ঘিরে আন্দোলন নতুন মাত্রা পায়। তিনি চীন সফর শেষে ১৪ জুলাই সংবাদ সম্মেলন করেন। সেখানে এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, ‘সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিরা কোটা-সুবিধা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতিরা পাবে?’
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দাবিকে তাচ্ছিল্য করে শেখ হাসিনার দেওয়া এই বক্তব্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়। ক্ষোভে ফেটে পড়েন শিক্ষার্থীরা। ওই দিন গভীর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে বেরিয়ে এসে বিক্ষোভ করেন ছাত্রছাত্রীরা। পরদিন শিক্ষার্থীরা আবার বিক্ষোভে নামলে হামলা করে ছাত্রলীগ। সেদিন বহিরাগতদের এনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের ওপর ন্যক্কারজনক আক্রমণ করে ছাত্রলীগ (বর্তমানে নিষিদ্ধ সংগঠন)। এরপর গোয়েন্দাদের দিয়ে ছাত্র সমন্বয়কদের তুলে নিয়ে নির্যাতন করে, ভয়ভীতি দেখিয়ে আন্দোলন থামানোর চেষ্টা করা হয়। ১৫ জুলাই আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার পরদিন দেশজুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়। ১৬ জুলাই থেকে পুলিশ গুলি করতে শুরু করে। ওই দিন রংপুরে আবু সাঈদের মৃত্যু আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। পুলিশের বন্দুকের সামনে বুক পেতে দাঁড়ান বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অকুতোভয় আবু সাঈদ। একের পর এক গুলিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। এ ঘটনার ভিডিও গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে আন্দোলন আরও তীব্র হয়।
আন্দোলন দমাতে পুলিশের পাশাপাশি নামানো হয় আওয়ামী লীগের সশস্ত্র দলীয় কর্মীদের। ১৯ জুলাই কারফিউ জারি করে সরকার। ওই দিন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ঘোষণা দেন, ‘শুট অ্যাট সাইট’ (দেখামাত্র গুলি)-এর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। রাজধানীর প্রায় প্রতিটি এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নেমেছিলেন স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীসহ শ্রমজীবী মানুষ। আন্দোলনকারীদের পাশে দাঁড়ান শিক্ষক, অভিভাবক ও এলাকাবাসী। আন্দোলনে যুক্ত হন তখনকার বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক কর্মীরাও। একপর্যায়ে সরকার কারফিউ জারি করে এবং ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়। রাজধানীসহ গুরুত্বপূর্ণ শহর ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘিরে বিপুল পরিমাণে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও সেনা মোতায়েন করে আন্দোলন দমনের চেষ্টা করে। নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচার গুলি চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। যখন একের পর এক মানুষের লাশ পড়ছিল, সরকারপ্রধান তখন বিভিন্ন স্থাপনা পরিদর্শনে গিয়ে সেগুলোর ক্ষয়ক্ষতির চিত্র দেখিয়ে উন্নয়ন ধ্বংস হচ্ছে বলে প্রচার করছিল।
পতনের আগের কয়েক দিন সারা দেশে অস্ত্রসহ নতুনভাবে দলীয় কর্মীদের মাঠে নামায় আওয়ামী লীগ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি তারাও নির্বিচার গুলি করে। ওই সময় পুলিশের ঢাকার ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনারের বক্তব্যের একটি ভিডিও চিত্র ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। তাতে দেখা যায়, ওই কর্মকর্তা আন্দোলনের একটি ভিডিও চিত্র দেখিয়ে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলছেন, ‘গুলি করি একটা, একটাই মরে। অন্যগুলো সরে না।’ শেষ মুহূর্তে সেনাবাহিনীকেও ছাত্র-জনতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা করেন শেখ হাসিনা। সেনাসদস্যরা ছাত্র-জনতাকে গুলি করতে অস্বীকৃতি জানায়। সশস্ত্র বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তারাও ছাত্র-জনতার পক্ষে অবস্থান নিয়ে বক্তব্য-বিবৃতি দেন, মিছিল করেন। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সমাবেশ থেকে ৩ আগস্ট সরকার পতনের এক দফা ঘোষণা দিয়ে পরদিন সারা দেশে অসহযোগ কর্মসূচি দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। কর্মসূচি ঠেকাতে ৪ আগস্ট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাও ব্যাপকভাবে গুলি চালান। ওই এক দিনেই সারা দেশে শতাধিক মানুষকে হত্যা করে তারা। এ রকম এক উত্তাল পরিস্থিতিতে ঘোষণা আসে ছাত্র-জনতার ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ৬ আগস্টের পরিবর্তে ৫ আগস্ট হবে। একপর্যায়ে সরকার কারফিউ জারি করে এবং ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়। রাজধানীসহ গুরুত্বপূর্ণ শহর ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘিরে বিপুল পরিমাণে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও সেনা মোতায়েন করে আন্দোলন দমনের চেষ্টা করে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যখন দিশেহারা সরকার, তখন পতনের ঠিক আগ মুহূর্তে অর্থাৎ ১ আগস্ট জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করে সরকার। এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ২৮ আগস্ট জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করে জারি করা প্রজ্ঞাপন বাতিল করে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হওয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
৫ আগস্ট সকাল থেকে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে বিপুলসংখ্যক মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন। যা একপর্যায়ে জনস্রোতে পরিণত হয়। সবার গন্তব্য ছিল গণভবন ও জাতীয় সংসদ ভবন। এই জনস্রোত গণভবনে পৌঁছানোর আগেই শেখ হাসিনা সামরিক বাহিনীর একটি বিমানে করে ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে দেশ ছাড়েন। এরপর বিক্ষুব্ধ জনতা প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবন ও সংসদ ভবনে ঢুকে পড়ে, ভাঙচুর চালায়।
বাংলাদেশের ইতিহাসে রাষ্ট্র ক্ষমতায় একটানা সবচেয়ে বেশি দিন টিকে ছিলেন শেখ হাসিনা। আবার ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশ ছেড়ে পলায়নের ইতিহাসও তিনি তৈরি করলেন। তার পতনের পর জনরোষ থেকে বাঁচতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্র থেকে মাঠ পর্যায় পর্যন্ত সব নেতা-কর্মী, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, দলটির আজ্ঞাবহ সরকারি চাকরিজীবী ও ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পেশাজীবীও একযোগে গা ঢাকা দেন। অনেকে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে পালান। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে মোট কতজন শহীদ হয়েছেন, সেই হিসাব এখনো পুরোপুরি পাওয়া যায়নি। গণ-অভ্যুত্থানসংক্রান্ত বিশেষ সেল গত ২১ ডিসেম্বর প্রাথমিক হিসাবে জানিয়েছে, তখন পর্যন্ত ৮৫৮ জন শহীদ ও সাড়ে ১১ হাজার জন আহত হওয়ার তথ্য পেয়েছিল।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর তার সময়ের জুলুম-নির্যাতনের ঘটনাগুলো আরও ব্যাপকভাবে সামনে আসতে থাকে। তার মধ্যে অন্যতম গোপন বন্দিশালা, যেখানে মানুষকে গুম করে দিনের পর দিন আটকে রাখা হতো। ৫ আগস্টের পর ‘আয়নাঘর’ নামে পরিচিতি পাওয়া গোপন বন্দিশালা থেকে ছাড়া পান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুল্লাহিল আমান আযমী, ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত মীর কাশেম আলীর ছেলে ব্যারিস্টার আহমেদ বিন কাশেম আরমান ও পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক দল ইউপিডিএফের নেতা মাইকেল চাকমা। যারা ৫ থেকে ৮ বছর পর্যন্ত গুম ছিলেন।
সরকারের কাছে গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের দেওয়া অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গুম ও গোপন বন্দিশালায় আটকে রাখার মূল নির্দেশদাতা ছিলেন শেখ হাসিনা। গুম হওয়া অনেক মানুষ এখনো নিখোঁজ। যাদের জীবিত থাকার সম্ভাবনা ক্ষীণ বলে মনে করছে কমিশন।
২০২৪ সাল শুরু হয়েছিল শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কারাদণ্ডাদেশের মধ্য দিয়ে। বেশ কয়েক বছর ধরে নানাভাবে হেনস্তার পর ইউনূসকে বছরের প্রথম দিন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের এক মামলায় ছয় মাসের কারাদণ্ডাদেশ দেন শ্রম আদালত। যদিও শেখ হাসিনা সরকারের হয়রানিমূলক এ মামলা পরে টেকেনি। বছরের মাঝামাঝি এসে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের অবসান হয়। এরপর ৮ আগস্ট মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী শিক্ষার্থীদের বিশেষ অনুরোধে তিনি এই দায়িত্ব নেন। আর তাকে যিনি জেলে পুরতে চেয়েছিলেন সেই শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। কেবল তা-ই নয়, নতুন সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচারের উদ্যোগ নিয়েছে। ইতিমধ্যে শেখ হাসিনাসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন এই আদালত। এখন তাকে বিচারের মুখোমুখি করতে দেশে ফেরানোর চেষ্টা করছে অন্তর্বর্তী সরকার।
২০২৪ সালের শুরুতে অনুষ্ঠিত হয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনমনে ক্ষোভের সঞ্চার করে। এ নির্বাচনে ২৯৮টি আসনের মধ্যে ২২৩টিতে জয়লাভ করে আ’লীগ। এরপর স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয় পান ৬১টি আসনে। জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি পায় মাত্র ১১টি আসন। শেখ হাসিনা পঞ্চমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন। তবে, এ নির্বাচন দেশ ও আন্তর্জাতিক মহলে বিতর্কের জন্ম দেয়। কারণ, দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ শরিক দলগুলো এ নির্বাচন বর্জন করে। নির্বাচনের প্রায় তিন সপ্তাহ পর ফেব্রুয়ারি মাসে নতুন করে সরকার পতনের আন্দোলন শুরু করে বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীসহ সমমনা দলগুলো।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট শপথ গ্রহণ করে অন্তর্র্বতীকালীন সরকার। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় উপদেষ্টা পরিষদ। বঙ্গভবনে তাদের শপথবাক্য পাঠ করান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। বঙ্গভবনে শপথ নেওয়ার পর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, পূর্ববর্তী সরকারের ঘৃণ্য চেষ্টায় ব্যবহৃত হয়ে যারা অপরাধ সংঘটিত করেছেন তাদের আইনানুগ বিচারের মাধ্যমে শাস্তি দেওয়া হবে। একই কথা সব মন্ত্রণালয়, সংস্থা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রের জন্য প্রযোজ্য। সব অপরাধীর বিচার হবে।
২০২৪ বাংলাদেশকে বিশ্বের বর্ষসেরা দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ লড়াই ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে সমকালীন বিশ্বের বিরল এক গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশ স্বৈরাচার ও আধিপত্যবাদী আগ্রাসন থেকে মুক্ত হয়। জনতার এ অভ্যুত্থান গোটা বিশ্বকে অবাক করেছে। এ অভ্যুত্থান বাংলাদেশকে স্বাধীন, সার্বভৌম অস্তিত্ব নিয়ে আগামীতে টিকে থাকার প্রেরণা জোগাবে। অপশক্তির বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য ও সংহতির এ দীক্ষা এদেশের জনগণের রক্তের মধ্যে সঞ্চালিত হয়েছে। যেকোনো বৈরিতার মোকাবিলায় এ শক্তির জাগরণ ঘটবে। নানা সম্প্রদায়, মত ও ধর্ম-বর্ণের সম্মিলিত শক্তি নিয়ে বাংলাদেশ নতুন সমৃদ্ধির অভিযাত্রায় এগিয়ে যাবে। ২০২৪ এর জুলাই-আগস্ট সেই ইতিহাসের সন্ধিক্ষণ, যা কখনো হারিয়ে যাবে না, শতাব্দীর পর শতাব্দী আমাদের জাতীয় ইতিহাসের গৌরবের স্মারক হয়ে থাকবে। এ বছর শেষহীন জুলাইয়ের মতো আমাদের স্মৃতি ও কর্মের মধ্যে উদ্ভাসিত হবে।
জা ই / এনজি