মোহাম্মদ জাফর ইকবাল
২০ ডিসেম্বর ২০২৪
গত ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসে জাতীর উদ্দেশে দেয়া ভাষণে সংসদ নির্বাচন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপেদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তব্যে সরগরম রাজনৈতিক অঙ্গণ। তিনি বলেছেন, ২০২৫ সালের শেষের দিকে অথবা ২০২৬ সালের প্রথমার্ধে নির্বাচন হতে পারে। এর আগে গত ১৭ নভেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন পূর্তি উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা বলেছিলেন, নির্বাচনের ট্রেন যাত্রা শুরু করেছে, এটা আর থামবে না।
নির্বাচন নিয়ে কথা বলছেন অন্যান্য উপেদষ্টাসহ রাজনৈতিক দলগুলো। সবাই নির্বাচন প্রসঙ্গে বক্তব্য দিলেও অধিকাংশই বলছেন, প্রয়োজনীয় সংষ্কার শেষেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। একইসাথে জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে দেশব্যাপী পলায়নকারী আওয়ামী লীগ সরকার যে হত্যাকান্ডসহ নারকীয় তান্ডব চালিয়েছে, তার বিচার হতে হবে। তারা বলছেন, সংস্কার এবং বিচার না হাওয়ার আগে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে আবারো দেশে ফ্যাসিবাদের আগমন হতে পারে।
অন্তর্বর্তী সরকার যে যে সংস্কার প্রয়োজন বলে মনে করে, সেসব সংস্কার শেষ করেই আগামী জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা উচিত বলে যারা মনে করেন তাদের বেশির ভাগই বিচার বিভাগ, সংবিধান, অর্থনৈতিক খাত, পুলিশ, ও নির্বাচন কমিশনসংক্রান্ত সংস্কারগুলো করার পক্ষে মত দিয়েছেন।
নির্বাচন নিয়ে উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেন, নির্বাচনের বিষয়টি সরকারের নজরে আছে বলেই নির্বাচনি উদ্যোগ আছে। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে। অন্যান্য কার্যক্রমও চলমান আছে। সরকারের দিক থেকে দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে সংস্কার। বাংলাদেশের জনগণ যে জন্য জীবন দিয়েছে, এই সংস্কারের একটি দৃশ্যমান প্রক্রিয়া হওয়ার পরই নির্বাচন হবে। সংস্কার কার্যক্রম চলমান আছে। সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনগুলো আসুক।
প্রয়োজনীয় সংস্কার করেই নির্বাচন চায় গণতন্ত্র মঞ্চ। তারা বলছে, প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে আগামী বছরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন করা সম্ভব। মঞ্চের সমন্বয়ক বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন, রুপান্তর বা সংস্কারগুলো সম্পন্ন করে ২০২৫ সালে জাতীয় নির্ব্চান করাটা সম্ভব।
এদিকে সংষ্কারের পক্ষে দেশের বেশির ভাগ মানুষ। সম্প্রতি ভয়েস অব আমেরিকা বাংলার তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশে এক জরিপের ফলাফলে এ তথ্য জানা গেছে। সেই জরিফে ৬১ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ মনে করেন, এক বছরের মধ্যে আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত। তবে আরেকটি প্রশ্নের উত্তরে বেশির ভাগ মানুষ (৬৫ দশমিক ৯ শতাংশ) বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার যা যা সংস্কার করা প্রয়োজন মনে করবে, তার সবগুলো করার পরই নির্বাচন আয়োজন করা উচিত। আর শুধু নির্বাচন সংক্রান্ত জরুরি সংস্কারগুলো শেষ করে নির্বাচন আয়োজনের পক্ষে মত ৩১ দশমিক ৯ শতাংশ উত্তরদাতার।
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর নানা বিষয়ে বক্তব্য আসলেও নির্বাচন নিয়েই বেশি মাতামাতি কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের। তারা বলছেন, রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় এসে প্রয়োজনীয় সংষ্কার করবে। তবে দেশের নাগরিক, অন্তবর্তী সরকারের উপদেষ্টাসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই মনে করে, সংস্কার ও ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের বিরুদ্ধে আসা অভিযোগের বিচার হওয়ার পরই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
নির্বাচন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে এখনো নির্দিষ্ট কোনো রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়নি। তাদের বক্তব্য, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের জন্য দ্রুত প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো করার পরই আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এদিকে আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বলছে, রাষ্ট্র সংস্কারের কাজগুলো শেষ হওয়ার আগে নির্বাচন হলে আবার নতুন করে ‘ফ্যাসিবাদের’ আবির্ভাব ঘটবে। তারা বলছে, কেবল একটি নির্বাচন করার জন্য ২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান হয়নি।
সংষ্কার শেষেই দেশে নির্বাচন হবে, এমনটি জানিয়েছিলেন সেনা প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। গত ২৩ সেপ্টেম্বর এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, আগামী ১৮ মাসের মধ্যে যাতে নির্বাচন হতে পারে, সে জন্য গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারগুলো সম্পন্ন করতে এই সরকারকে সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। যদিও পরবর্তীতে তিনি বলেছেন, নির্বাচন নিয়ে দেয়া বক্তব্য একান্তই তার নিজস্ব। প্রধান উপদেষ্টাই নির্বাচনের সময় ঘোষণা করবেন।
যত দ্রুত সম্ভব সংস্কার প্রক্রিয়া শেষ করে নির্বাচনের সময়সূচি ঘোষণা এবং একটি নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন রাজনীতিবিদরা। তারা বলছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ঘোষিত কমিশনগুলো তাদের চূড়ান্ত সুপারিশ প্রণয়ন প্রক্রিয়া নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ করবে বলেই তাদের আশা। এরপর জনগণের আকাংখামূলক একটি প্রকৃত নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা দেওয়া হবে, এমনটাও প্রত্যাশা তাদের।
দায়িত্ব নেযার পর প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস রাষ্ট্র সংস্কারের রূপরেখা তৈরির জন্য একটি পথরেখা ঘোষণা করেছেন। যেখানে ছয়টি কমিশন গঠনের কথা জানিয়ে এর মাধ্যমে সংস্কারের রূপরেখা চূড়ান্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। সবশেষ গত ১৬ ডিসেম্বর তিনি বলেছেন, ২০২৫ সালের শেষ দিক থেকে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করা যায়। তবে সেক্ষত্রে সকল প্রধান সংস্কারগুলি সম্পন্ন করে নির্বাচন আয়োজন করার ব্যাপারটি তিনি তুলে ধরেন।
সংষ্কার প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে যেসব সংস্কারের কথা বলেছেন এবং যাদের দায়িত্ব দিয়েছেন, এই সংস্কারগুলো যেন অতিদ্রুত হয়। অন্তর্বর্তী সরকার যত দ্রুত সম্ভব তাদের কাজগুলো শেষ করে নির্বাচনের দিকে যাবে, এমনটাই তাদের প্রত্যাশা। তিনি বলেন, বিগত ফ্যাসিবাদী সরকার গণতান্ত্রিক অধিকার একেবারে ধ্বংস করে ফেলেছিল। আমরা সবাই সংস্কারের কথা বলছি এবং সংস্কার যে প্রয়োজন, সেটা বলেছি। সে ক্ষেত্রে অতিদ্রুত যেন এই সংস্কারগুলো করা হয়।
সূত্র মতে, ভয়েস অব আমেরিকার জরিফে নির্বাচন কমিশন সংস্কারের পক্ষে মত দিয়েছেন ৯৬ দশমিক ৫ শতাংশ উত্তরদাতা। পুলিশ সংস্কারের পক্ষে মত দিয়েছেন ৯২ দশমিক ৩ শতাংশ, বিচার বিভাগ সংস্কারের পক্ষে ৯৫ দশমিক ৩ শতাংশ এবং অর্থনৈতিক খাতে সংস্কারের পক্ষে ৯৬ দশমিক ৪ শতাংশ উত্তরদাতা মত দিয়েছেন। সংবিধান সংস্কার চান ৯২ দশমিক ৫ শতাংশ উত্তরদাতা। দেশের ৫৮ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের তুলনায় দেশ পরিচালনায় ভালো করছে।
জরুরি সংস্কার শেষে সব রাজনৈতিক দল ও অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা করবে সরকার, এমনটিই বলছেন উপদেষ্টারা। সম্প্রতি রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক অনুষ্ঠানে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, সংস্কার কমিশন থেকে প্রস্তাব আসবে, জনগণ কথা বলবে। চূড়ান্ত সংস্কার প্রস্তাবনা হবে। সেই মোতাবেক যে পদক্ষেপ নেওয়ার তা নেব। আমরা বারবার বলেছি যত দ্রুত সম্ভব জরুরি সংস্কারগুলো শেষে নির্বাচনের তারিখ জানিয়ে দেব। সংস্কার প্রস্তাব কী আসবে, সংস্কারে কতটুকু সময় লাগবে, এটা না জেনে তো নির্বাচনের সময়টা বলে দেওয়া যাচ্ছে না। বারবার বলা হচ্ছে যত দ্রুত সম্ভব দিয়ে দেওয়া হবে।
সংস্কার শেষে নির্বাচন করার ম্যান্ডেট আছে বলে মন্তব্য করেছেন নৌ-পরিবহন উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কেউ যেহেতু রাজনীতি করে না, তাই সংস্কার শেষে নির্বাচন করার ম্যান্ডেট আছে। তবে সময় হলেই সব পরিষ্কার হবে।
ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম বলেছেন, প্রয়োজনীয় সকল সংস্কার শেষে জাতীয় ঐক্যমতের ভিত্তিতে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে। তিনি বলেন, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি। ফ্যাসিস্ট সরকার গত ১৬ বছর দেশে অনেক অনিয়ম দুর্নীতি করেছে। সংস্কারের ক্ষেত্রে স্টেক হোল্ডারদের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
জেএসডির সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ বলেন, শুধু নির্বাচন করার জন্য আবু সাঈদ ও মুগ্ধরা জীবন দেয়নি। পরিবর্তনের কাজও করতে হবে, তা না করতে পারলে ভবিষ্যতে হতাশা বাড়বে।
সংস্কার ছাড়া যারা নির্বাচনের কথা বলে, তারা মনে হয় ষড়যন্ত্রকারীদের পাতা ফাঁদে পা দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করিম (পীর চরমোনাই) তিনি বলেন, প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করে নির্বাচন করতে হবে।
নবনিযুক্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দীন গত ২৪ নভেম্বর বলেছেন, জাতি হিসেবে এত অধৈর্য হওয়ার কোনো কারণ নাই। প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ দেওয়ার মতো বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা করতে পারব।
জা ই / এনজি