মতামত
এছাড়া, শিল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা এবং পুরোনো ধনী দেশ ও নতুন শিল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব শ্রমিকদের জন্য নতুন ঝুঁকি তৈরি করছে। বাংলাদেশের পোশাক শিল্প, যা দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি, বৈশ্বিক বাজারে ক্রমবর্ধমান খরচ ও কঠোর শ্রম আইনের চাপের মুখে পড়ছে।
এরকম প্রেক্ষাপটে বছর ঘুরে আবার আন্তর্জাতিক শ্রম দিবস আমাদের সামনে। অন্যান্য প্রচুর দিবসের মাঝে এই দিনটি এখন আর তেমন আবেদন তৈরি করে না। সরকারি পর্যায়ে কিছু বিলবোর্ড আর পোস্টারের বাইরে বেশি কিছু করতে দেখা যায় না। নেহায়েত যেকোনো একটা ছুটির দিন মাত্র।
যারা শ্রম অধিকার নিয়ে কাজ করেন তাদের মধ্যেও, দুঃখজনক হলো একটা দায়সারা উদযাপনের বাইরে তাৎপর্যময় তেমন কিছু চোখে পড়ে না। এ থেকে বোঝা যায়, বাংলাদেশ তো বটেই, সারা বিশ্বেই একটা রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বর্গ হিসেবে শ্রমিক এখন একবারেই প্রান্তিক। তাই আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের প্রাক্কালে শ্রমিকদের ব্যক্তিগত অর্থনীতি বিশেষ করে বাংলাদেশের দিনমজুরদের গৃহস্থালি অর্থনীতির বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
বৈশ্বিক পুঁজিবাদের এই যুগে শ্রমের মূল্য ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে, অথচ জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে এই সংকট আরও প্রকট। বাংলাদেশের শ্রমিকরা, বিশেষ করে আধুনিক বিশ্বের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, নানাবিধ চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। এই পরিস্থিতিতে শ্রমিকদের অধিকার, ন্যায্য মজুরি এবং নিরাপদ কর্মপরিবেশের দাবি প্রায়শই উপেক্ষিত হয়।
দেশের শ্রমিক সমাজ একটি বৈচিত্র্যপূর্ণ গোষ্ঠী। ‘শ্রমিক’ বলতে শুধু কারখানার কর্মীই বোঝায় না—এটি একটি বিস্তৃত শ্রেণি, যেখানে রয়েছে শিল্প শ্রমিক, কৃষি শ্রমিক, খনি শ্রমিক, নির্মাণশ্রমিক, গার্মেন্টস কর্মী থেকে শুরু করে দিনমজুর পর্যন্ত।
শিল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা এবং পুরোনো ধনী দেশ ও নতুন শিল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব শ্রমিকদের জন্য নতুন ঝুঁকি তৈরি করছে।
বাংলাদেশে শিল্প শ্রমিকদের মধ্যে পোশাক শিল্পের শ্রমিকরা সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় রয়েছে, যারা দেশের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৩.৪৯ শতাংশ অবদান রাখে। কৃষি শ্রমিকরা, যারা জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক, দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। তবে, কৃষি খাত জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির সম্মুখীন। খনি শ্রমিকরা, যদিও সংখ্যায় কম, অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করে।
এছাড়া, শ্রমিকদের মধ্যে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাজন হলো আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক খাত। বাংলাদেশে শ্রমশক্তির প্রায় ৯৬.৬ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত, যেখানে মজুরি কম, কাজের নিরাপত্তা নেই এবং সামাজিক সুরক্ষা প্রায় অস্তিত্বহীন। আনুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা, যেমন পোশাক শিল্পের কর্মীরা, তুলনামূলকভাবে ভালো মজুরি এবং কিছুটা আইনি সুরক্ষা পায়, কিন্তু তারাও নানা শোষণের শিকার।
শিল্প শ্রমিকদের তুলনায় কৃষি শ্রমিকদের আয় উল্লেখযোগ্যভাবে কম। পোশাক শিল্পে একজন শ্রমিকের গড় মাসিক আয় প্রায় ১০,০০০-১২,০০০ টাকা, যেখানে কৃষি শ্রমিকরা গড়ে ৫,০০০-৭,০০০ টাকা আয় করেন। দিনমজুরদের আয় আরও অনিশ্চিত, গড়ে দৈনিক ৩০০-৫০০ টাকা, যা মাসে ৬,০০০-১০,০০০ টাকার মধ্যে ওঠানামা করে। এই আয় দিয়ে একটি পরিবারের মৌলিক চাহিদা মেটানো প্রায় অসম্ভব।
দক্ষিণ এশিয়ায় লিঙ্গভিত্তিক মজুরি বৈষম্য একটি গুরুতর সমস্যা। দক্ষিণ এশিয়ায় নারী শ্রমিকদের মজুরি পুরুষের তুলনায় গড়ে ২০-৩০ শতাংশ কম। বাংলাদেশে একজন নারী শ্রমিক গড়ে ১২.২ শতাংশ কম মজুরি পান পুরুষের তুলনায়। পোশাক শিল্পে নারী শ্রমিকরা মোট কর্মীর ৮০ শতাংশ হলেও তাদের আয় পুরুষদের চেয়ে কম। এখানে নারীদের মজুরি পুরুষের তুলনায় ২০ শতাংশ কম। দক্ষিণ এশিয়ার আনুষ্ঠানিক খাতে গড় মাসিক মজুরি প্রায় ১৫,০০০ থেকে ২০,০০০ টাকা (প্রায় ১৩৫-১৮০ মার্কিন ডলার), তবে নারীদের মজুরি এর থেকে ৮-২০ শতাংশ কম।
বাংলাদেশের দিনমজুরদের জীবন সংগ্রামের এক করুণ ইতিহাস। কাজের নিশ্চয়তা নেই, সামাজিক সুরক্ষা নেই, চিকিৎসা বা শিক্ষার সুযোগ সীমিত। বর্তমান মূল্যস্ফীতির যুগে চাল, ডাল, তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় তাদের সংসার চালানো দুর্বিষহ। ফলে বাংলাদেশের দিনমজুররা অত্যন্ত অনিশ্চিত জীবনযাপন করে। তাদের কাজের কোনো নিশ্চয়তা নেই এবং মৌসুমি কাজের ওপর নির্ভরশীলতা তাদের আয়কে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে।
উদাহরণস্বরূপ, কৃষি দিনমজুররা বছরের কিছু সময় কাজ পায় না, যা তাদের পরিবারের ওপর অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে। এছাড়া, পেশাগত ঝুঁকি যেমন দুর্ঘটনা, আঘাত এবং দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য সমস্যা তাদের জীবনকে আরও জটিল করে।
মূল্যস্ফীতি দিনমজুরদের জীবনকে আরও কঠিন করে তুলেছে। বাংলাদেশে ২০২০ সাল থেকে খাদ্য ও জ্বালানির দাম ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। একটি দিনমজুর পরিবারের গড় আয় ১০,০০০-১২,০০০ টাকা, কিন্তু ব্যয় তার চেয়ে অনেক বেশি। একটি দিনমজুর পরিবারের জন্য শিশুদের খাদ্য, শিক্ষা, এবং স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা প্রায় অসম্ভব।
বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব লেবার স্টাডিজের মতে, ন্যূনতম জীবনযাপনের জন্য মাসিক ৩৩,৩৬৮ টাকা প্রয়োজন, যেখানে দিনমজুরদের আয় এর তিনগুণ কম। ফলে, অনেক পরিবার ঋণের ওপর নির্ভর করে, যা তাদের দারিদ্র্যের চক্রে আটকে রাখে। এ ধরনের পরিবারে শিশুরা অপুষ্টির শিকার হয়, স্কুলে পাঠানো সম্ভব হয় না, অসুখ-বিসুখে চিকিৎসা করা যায় না।
দুঃখজনকভাবে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কারের এজেন্ডায় শ্রমিক অধিকার উল্লেখযোগ্য স্থান পায়নি। সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জমা দেওয়া শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে শ্রম আইনের সংস্কার, নিরাপদ কর্মপরিবেশ এবং শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়ার অধিকারের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
বৈশ্বিক পুঁজিবাদের এই যুগে শ্রমের মূল্য ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে, অথচ জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে এই সংকট আরও প্রকট।
তবে এই প্রতিবেদনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ইচ্ছার অভাব স্পষ্ট। সরকার ও শিল্পমালিকরা শ্রমিকদের দাবিকে প্রায়ই উপেক্ষা করে, ফলে শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রাম আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। দিনমজুরদের মতো সবচেয়ে দুর্বল শ্রমিক গোষ্ঠীর জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট নীতি বা সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি এখনও কার্যকর হয়নি।
আন্তর্জাতিক শ্রম দিবসে শ্রমিকদের সংকট ও অধিকারের কথা বলার সময় এসেছে। বৈশ্বিক অর্থনীতির নিষ্ঠুর প্রতিযোগিতা ও দেশীয় রাজনীতির উদাসীনতা যেন শ্রমিকদের ভাগ্যকে আরও বিপন্ন করছে না, তা নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশের দিনমজুরদের দুর্দশা আমাদের সামনে একটি কঠিন প্রশ্ন তুলে ধরে—আমরা কি সত্যিই শ্রমিকদের অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ?
বৈশ্বিক অর্থনীতির চাপ, লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য এবং রাজনৈতিক উদাসীনতার মধ্যে শ্রমিকদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হলে আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং নীতিগত সংস্কার প্রয়োজন। শ্রমিকদের অধিকার শুধু একটি দিবসের স্লোগান নয়, এটি একটি সামাজিক দায়িত্ব।
লেখক : অধ্যাপক, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়