বিকাল ৪:৩৯ | শনিবার | ২৪ মে, ২০২৫ | ১০ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২, গ্রীষ্মকাল | ২৫ জিলকদ, ১৪৪৬

মানবতাবিরোধী অপরাধ:  হাসিনা ও কাদেরসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের রেড নোটিশ

তোফাজ্জল হোসাইন কামাল
১৯ মে ২০২৫

জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে ‘রেড নোটিশ’ জারি করেছে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোল। এর আগে বিদেশে পলাতক ওই ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করতে ইন্টারপোলের কাছে পৃথক তিনটি ধাপে আবেদন করে বাংলাদেশ পুলিশের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি)। শেখ হাসিনাসহ যাঁদের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করা হয়েছে, তাঁরা হলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত ও শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। সম্প্রতি এই নোটিশ জারি করা হয়েছে বলে পুলিশ সদর দফতরের একাধিক সূত্রে জানা গেছে।

তবে ইন্টারপোলের ওয়েবসাইটে এই ১২ জনের ছবি ও তথ্য মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায় এখনো প্রকাশ করা হয়নি। তাই দেখা যায়নি। কারণ হিসেবে ইন্টারপোলের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, বেশিরভাগ রেড নোটিশ কেবল আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ব্যবহারের মধ্যে সীমাবদ্ধ। সবার জন্য ওয়েবসাইটে তা প্রকাশ করা হয়নি। শুধুমাত্র আইনশৃঙ্খলা বাহিনীই এই ১২ জনের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ দেখতে পারবে।

এনসিবি সূত্রে জানা গেছে, রেড নোটিশ জারির তথ্য ইন্টারপোলের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। তবে সেটি শুধুমাত্র পুলিশ দেখতে পারবে। হয়তো কিছুদিন পরে ইন্টারপোল এই তথ্য সবার জন্য উন্মুক্ত করতে পারে। ইন্টারপোলের ওয়েবসাইট সূত্রে জানা গেছে, গতকাল ১৮ মে রোববার পর্যন্ত ৬২ বাংলাদেশী অপরাধীর নাম ও তাদের তথ্য ইন্টারপোলের ওয়েবসাইটে রয়েছে।

এর আগে গত ১০ এপ্রিল সাবেক আইজিপি বেনজীরের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করে ইন্টারপোল। এ নিয়ে এ যাবৎ ৭৫ জন বাংলাদেশীর বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করলো ইন্টারপোল। তবে, এবারই প্রথম একসাথে শীর্ষ পর্যায়ের ১২ জনের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারীর ঘটনা ঘটলো। বেনজীর ছিলেন ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ৬৩তম ব্যক্তি। ৬৪ তম ব্যক্তিটি হচ্ছেন, শেখ হাসিনা। পর্যায়ক্রমে বাকীরাও আছেন।

পুতুল ছাড়া শেখ হাসিনাসহ যে ১১ জনের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করা হয়েছে, তাঁদের বিরুদ্ধে করা আবেদনে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার তথ্য-উপাত্ত যুক্ত করা হয়েছে।

২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনের অবসান হয়। প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। তখন থেকে তিনি সেখানেই আছেন। সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ ১০ জন গত ৫ আগস্টের আগে-পরে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। এর মধ্যে সাবেক মেয়র তাপস দেশ ছাড়েন ৩ আগস্ট। তার মেয়ে পুতুল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক অফিসের (ডব্লিউএইচওএসইএআরও) আঞ্চলিক পরিচালক। ওই দায়িত্ব পালনের জন্য তিনিও ভারতে রয়েছেন।

বেনজীরের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করতে ইন্টারপোলের কাছে আবেদন করা হয় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে। এর আগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার একটি আদালত বেনজীরের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারির জন্য ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলেই ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অনুসন্ধান চলাকালে গত বছরের ৪ মে সপরিবারে দেশ ছাড়েন। তিনি ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আইজিপি ছিলেন। এর আগে তিনি ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের এপ্রিল পর্যন্ত র‌্যাবের মহাপরিচালক ছিলেন।

পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানায়, আদালত, প্রসিকিউশন (রাষ্ট্রপক্ষ) অথবা তদন্ত সংস্থার অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ সদর দপ্তরের এনসিবি শাখা ইন্টারপোলে রেড নোটিশ জারির আবেদন করে থাকে।

পুলিশের সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, বর্তমান সরকারের আমলে সর্বপ্রথম শেখ হাসিনাসহ যে ১২ জনের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারির আবেদন করা হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে করা আবেদনে আর্থিক অপরাধের অভিযোগ তুলে ধরা হয়। অন্যদের বিরুদ্ধে করা আবেদনে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার তথ্য-উপাত্ত যুক্ত করা হয়।

শেখ হাসিনা ও বেনজীর আহমেদ ছাড়া অন্য ১০ জনের বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে এনসিবি থেকে ইন্টারপোলের কাছে আবেদন করা হয় ১০ এপ্রিল। এর আগে তাঁদের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিশ জারি করার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দপ্তরে নথিপত্রসহ চিঠি পাঠায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়। শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করতে রেড অ্যালার্ট জারির জন্য ইন্টারপোলের কাছে আবেদন করতে গত বছরের নভেম্বরে পুলিশ সদর দপ্তরকে অনুরোধ করেছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়। এনসিবি যে ১২ জনের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারির আবেদন করে, তাঁদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের আদালত থেকে বিভিন্ন মামলায় ওয়ারেন্ট বা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে। তবে ইন্টারপোলে রেড নোটিশ জারির আবেদনের বাইরে ভারতসহ যেসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্দী প্রত্যর্পণ চুক্তি রয়েছে, সে চুক্তির আওতায় বিদেশে পলাতক ব্যক্তিদের ফেরানোর চেষ্টাও রয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। এখনো সেখানেই অবস্থান করছেন তিনি। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্দী প্রত্যর্পণ চুক্তি রয়েছে। এই চুক্তির আওতায় তাঁকে ফেরত আনতে বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের কাছে আবেদন করেছে। তবে বেনজীর আহমেদের ঘটনাটি আর্থিক দুর্নীতি বা অপরাধ হওয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে নোটিশ জারির ক্ষেত্রে দ্রুত পদক্ষেপ দেখা যায়।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত মোট তিনটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত হত্যা, গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে একটি মামলা রয়েছে। সেই মামলায় শেখ হাসিনার পাশাপাশি পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনও আসামি। এ ছাড়া ২০১৩ সালে রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীদের হত্যা-নির্যাতনের ঘটনায় একটি এবং বিগত সাড়ে ১৫ বছরে গুম-খুনের ঘটনায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আরেকটি মামলা রয়েছে।

বিদেশে পালিয়ে থাকা আসামীদের অবস্থান শনাক্ত করতে ইন্টারপোল সহযোগিতা করে থাকে। অন্যদিকে বিদেশে পলাতক ব্যক্তিদের সম্ভাব্য অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেলে সেটিও সংশ্লিষ্ট দেশ ইন্টারপোলকে জানায়।

ইন্টারপোলের সদস্যভুক্ত দেশ এখন ১৯৬টি। পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, অপরাধ ও অপরাধীর তথ্য যাচাই-বাছাই এবং আদান-প্রদানে ১৯৬টি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশ পুলিশের এনসিবির নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। কোনো অপরাধী দেশ ত্যাগ করে অন্য দেশে অবস্থান করলে তাঁকে আইনের আওতায় আনতে সংশ্লিষ্ট দেশ তাঁর বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারির আবেদন করে থাকে।

ইন্টারপোল যেসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করে, তা তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে। গতকাল রোববার রাতে ইন্টারপোলের ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখা যায়, মোট ৬ হাজার ৫৮৩ জনের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করা আছে। এর মধ্যে ৬২ জন বাংলাদেশি। তবে রেড নোটিশ জারি করা বাকী ১৩ জনের কারও নাম তালিকায় নেই।

ইন্টারপোলের ওয়েবসাইটে রেড নোটিশ জারির তালিকায় থাকা বাংলাদেশীদের মধ্যে আছেন পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) পরিদর্শক মামুন এমরান খান হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদ-প্রাপ্ত দুবাইয়ে পলাতক রবিউল ইসলাম ওরফে আরাভ খান, শীর্ষ সন্ত্রাসী ফেরদৌস জাহাঙ্গীর ওরফে কালা জাহাঙ্গীর, শীর্ষ সন্ত্রাসী জাফর আহমেদ মানিক, শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান আহমেদ, শীর্ষ সন্ত্রাসী প্রকাশ কুমার বিশ্বাস, সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক অভি প্রমুখ। তালিকায় শেখ মুজিব হত্যা মামলায় মৃত্যুদ-প্রাপ্ত পলাতক আসামীদের নাম ও ছবি রয়েছে।

এনসিবির সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, রেড নোটিশ সরাসরি কোনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নয়। তবে এই নোটিশ জারি হলে আন্তর্জাতিক ভ্রমণের ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তি বিমানবন্দরে বা ইমিগ্রেশনে (অভিবাসন দপ্তরে) আটক হতে পারেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে গ্রেপ্তার হয়ে নিজ দেশে ফিরতে বাধ্য হওয়ার মতো পরিস্থিতির মুখোমুখিও হতে পারেন।

এর আগে রাজউকের পূর্বাচল প্রকল্পে প্লট বরাদ্দে দুর্নীতির মামলার আসামি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার পরিবারের সাত সদস্যকে দেশে ফেরাতে ইন্টারপোলের মাধ্যমে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। শেখ হাসিনার পাশাপাশি তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, বোন শেখ রেহানা, ভাগ্নে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক, ভাগ্নি টিউলিপ সিদ্দিক ও আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তীও রয়েছেন এই তালিকায়। এর মধ্যে শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে ইন্টারপোলের মাধ্যমে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির অনুমতি দেয় আদালত। এরপর সেটি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় হয়ে পুলিশ সদর দফতরে যায়। এরপর পুলিশ সদর দফতর ইন্টারপোলের কাছে আবেদন জানায়। এর ভিত্তিতেই পুতুলের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করলো ইন্টারপোল। বাকিদের বিরুদ্ধেও শিগগিরই আদালতে আবেদন করা হবে বলে দুদক কর্মকর্তাদের ভাষ্য। আদালতের আদেশ পাওয়া গেলে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরন করে তাঁদের বিরুদ্ধেও রেড নোটিশ জারির জন্য ইন্টারপোলের কাছে আবেদন জানাবে এনসিবি।

 

জা ই/ এনজি ডেস্ক

 

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *