ফারহানা আক্তার
০৬ অক্টোবর ২০২৪
পলায়নকারী আওয়ামী সরকারের আমলের চিত্র আর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ের পরিবেশে যেন আকাশ-পাতাল প্রার্থক্য। আগে যারা কর্মরত ছিলেন তাদের অধিকাংশই এখনো বহাল রয়েছে। শুধুমাত্র সিস্টেম আর জবাবদিহিতার কারণে এখন এক ভিন্ন পরিবেশ বিরাজমান হযরত শাহজালাল (র.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। শুধু যাত্রীসেবার মানোন্নয়নই নয়, পাশাপাশি পরিবর্তন এসেছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আচরণেও। স্যার-ম্যডিাম বলে যাত্রীদের সম্বোধন করা হচ্ছে।
যাত্রী হয়রানি, যাত্রীদের সাথে অশালীন আচরণ, অসহযোগিতা, এসবই ছিল হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের নিয়মিত ঘটনা। এসেবের বিরুদ্ধে অভিযোগ বা প্রতিবাদ করেও কোনো লাভ হতো না। বরং হেনস্থার পরিমাণ বাড়তো। কিন্তু গত ৫ আগেস্ট শেখ হাসিনার পালানোর পর দেশের সবচেয়ে বড় বিমানবন্দরটির যাত্রীসেবায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। দায়িত্বরতরা যাত্রীদের ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করছেন। যা আগে কখনোই ছিল না। উপরন্তু তাচ্ছিল্যের সুরে কথা বলতেন। কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করলে সহযোগিতা করছেন। ইমিগ্রেশনেও বেশি সময় লাগছে না। লাগেজও পাওয়া যাচ্ছে সময়ের অনেকত আগেই।
যাত্রীরা বলছেন, ঘাটতি যাই থাকুক, কর্মরতদের ব্যবহারে পরিবর্তন এসেছে, এটা খুবই ভালো দিক। দেশে পরিবর্তন আসার সঙ্গে সঙ্গে বিমানবন্দরের যাত্রীসেবায় এমন পরিবর্তন দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে।
সৌদি আরবের কর্মস্থলে ফিরতে যাওয়া রেমিট্যান্স যোদ্ধা আসিফ বলেন, এর আগেও অনেকবার দেশে এসছি। কিন্তু বিমানবন্দরে এমন চিত্র কখনোই দেখিনি। দীর্ঘদিন পর দেশে আসি একটু শান্তিতে থাকার জন্য। কিন্তু বিমানবন্দরে নেমেই আমরা নানা ভোগান্তির শিকার হতাম। তাতে মন অনেক খারাপ হয়ে যতে। তল্লাশীর নামে যেভাবে হয়রানি করা হতো, সেটি বলার মতো না। তবে এবারের চিত্র একেবারেই উল্টো। এচা যেন ভবিষ্যতেও বিদ্যমান থাকে। আমরা তো দেশের জন্যই কাজ করছি। একটু ভালো ব্যবহারই আমাদের কাম্য।
বিমানবন্দরের কার্যক্রম সম্পর্কে দুবাই ফেরত আকরাম হোসেন বললেন, বিমান অবতরণের পর ইমিগ্রেশনে খুবই অল্প সময় লেগেছে। এত কম সময় আগে কখনো লাগেনি। ইমিগ্রেশন পুলিশের ব্যবহারও খুবই আন্তরিক। লাগেজ পেতেও কম সময় লেগেছে। উন্নত দেশের মতো স্মার্টফোন ব্যবহারকারীদের কথা বলার জন্য ফ্রি ওয়াই-ফাই সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে। রয়েছে ফ্রি টেলিফোন সুবিধা ও শাটল সার্ভিস। নিজ দেশের বিমানবন্দরে এমন ভালো ব্যবহার ও ফ্রি সুবিধা পেয়ে খুবই ভালো লাগছে। আমরা ভবিষ্যতেও এমন কার্যক্রম দেখতে চাই।
আজ (০৬ অক্টোবর) রোববার দুপুরে সরেজমিন শাহজালাল বিমানবন্দরের টার্মিনাল-২ এ বিদেশগামী ও দেশে ফেরা প্রবাসীদের সঙ্গে কথা বলার সময় বিমানবন্দরের যাত্রীসেবা নিয়ে নিজেদের অভিব্যক্তি তুলে ধরেন তারা। যাত্রীরা বলছেন, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর বিমানবন্দরের সবকিছুতে পরিবর্তন লক্ষণীয়। আগের চেয়ে বিমানবাহিনীর বেশি সদস্যকে দায়িত্ব পালন করতে দেখা যাচ্ছে। তারা যাত্রীসেবায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। এই সেবা এবং ভালো ব্যবহার যেন অব্যাহত থাকে, সেদিকে কর্তৃপক্ষকে নজর দিতে হবে। মশা নিয়ন্ত্রণ, পরিচ্ছন্নতা, বখশিশের নামে হয়রানি, অহেতুক তল্লাশী বন্ধে জোর দিতে হবে।
জানা গেছে, ৫ আগস্টের পর বেবিচক চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী হযরাত শাহজালালসহ দেশের সব বিমানবন্দরে যাত্রী সেবা উন্নত করতে পদক্ষেপ নেন তিনি। তারই সুফল পাওয়া যাচ্ছে।
শাহজালাল বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, ২৪ ঘণ্টা সেবা দিয়ে যাত্রীদের সন্তুষ্ট করার লক্ষ্যে তারা কাজ করে যাচ্ছেন। একটি যাত্রীও যাতে ভোগান্তির শিকার না হন সে দিকে জোর দেওয়ার পাশাপাশি কর্মরতদের সেই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যাত্রীদের প্রধান অভিযোগ ইমিগ্রেশন ও লাগেজ পেতে দেরি হওয়ার বিষয়ে। এই দুইটি বিষয়ে বিশেষ নজর দেওয়ায় এখন সেবা উন্নত হয়েছে। ইমিগ্রেশন দ্রুত সম্পন্ন করতে ৩ শিফটের জায়গায় ৪ শিফট চালু করা হয়েছে। এতে সময় কম লাগছে। অল্প সময়ে লাগেজ পাওয়া নিশ্চিত করা হচ্ছে। বিমানবন্দরের ‘হেল্প ডেস্ক’ যাত্রীদের সব রকম সহায়তা করার জন্য ৩ শিফটে ২৪ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করছে। সার্বক্ষণিকভাবে ফ্রি ওয়াই-ফাই সুবিধা চালু করা হয়েছে। রয়েছে ফ্রি টেলিফোন বুথ।
বিদেশ ফেরত যাত্রীদের ব্যাগেজ সেবা দিতে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিমানবন্দর রেলস্টেশন ও বাস স্টেশন পর্যন্ত বিআরটিসির শাটল সার্ভিস চালু রয়েছে। বিশুদ্ধ পানির জন্য ৩টি ফিল্টার মেশিন বসানো হয়েছে। রয়েছে পর্যাপ্ত ট্রলি। সিকিউরিটি নিশ্চিতে জোর দেওয়া হচ্ছে।
শাহজালাল বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ জানায়, যাত্রীসেবা নিশ্চিত করতে ২০২৩ সালের ২৭ জুলাই হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কল সেন্টার উদ্বোধন করা হয়। এখন দেশের যে কেউ কল সেন্টারে (০৯৬১৪-০১৩৬০০) যোগাযোগ করে সেবা নিতে পারছেন। এ ছাড়া যাত্রীসেবা বাড়াতে একই দিন একটি ওয়েব পোর্টাল চালু করে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। এ কল সেন্টারে বিমানবন্দর-সংক্রান্ত যেকোন তথ্য জানা যায়। আর পোর্টালে কাস্টমস ডিউটি অফিসারদের নামের তালিকা, ইমিগ্রেশন পুলিশের সেবা, নিরাপত্তা সেবা এবং প্রাথমিক চিকিৎসা সেবার তথ্য, হুইলচেয়ার সেবা, ব্যাংকিং ও মানি এক্সচেঞ্জ সেবা, জরুরি প্রয়োজনে বিমানবন্দরে কর্তব্যরত সব কর্মকর্তার ফোন নম্বর, লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড সেবা, কোন উড়োজাহাজ পরিবহন সংস্থার কোন উড়োজাহাজ কখন ছেড়ে যাবে, কখন এসে পৌঁছাবে তা ঘরে বসেই জানতে পারছেন যাত্রীরা।
জানা গেছে, ইমিগ্রেশন ও ব্যাগেজ পাওয়া এখন দ্রুত সময়ে হলেও একসঙ্গে একাধিক বিমান অবতরণ করলে যাত্রীদের কিছুটা ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। এ বিষয়ে শাহজালাল কর্তৃপক্ষ বলছে, আমাদের এখানে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তৃতীয় টার্মিনাল চালু হয়ে গেলে এই সমস্যাও আর থাকবে না। জানতে চাইলে শাহজালাল বিমানবন্দরের পরিচালক কামরুল ইসলাম বলেন, যাত্রীসেবা উন্নত করা এবং সিকিউরিটি নিশ্চিতে জোর দেওয়া হয়েছে। যার সুফল এখন পাওয়া যাচ্ছে।
এ বিষয়ে বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া বলেন, যাত্রীসেবা নিশ্চিত করতে জোর দেওয়া হয়েছে। দায়িত্বরতদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যাত্রীসেবায় যেন কোনো ঘাটতি না হয়। কোনো অভিযোগ যেন না আসে। অভিযোগ এলেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রতিনিয়ত তদারকি করা হচ্ছে। আমি নিজে সরেজমিন পরিদর্শন করছি। দায়িত্বরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলছি। প্রবাসীদের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলতে বলা হয়েছে। এখন বিমানবন্দরের সেবায় প্রায় সব যাত্রীই সন্তুষ্ট। এখন শাহজালালের তৃতীয় টার্মিনাল চালু হলে বিশ^মানের সেবা পাবেন যাত্রীরা। বেবিচক চেয়ারম্যান বলেন, বিমানবন্দরে কর্মরত সব সংস্থার লোকেরা যাতে যাত্রীদের সঙ্গে সর্বোচ্চ ভালো ব্যবহার করে, এমন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রবাসীদের ‘স্যার বা ম্যাডাম’ বলতেও বলা হয়েছে। কারণ তাদের রেমিট্যান্সের ওপরই আমাদের দেশের অর্থনীতি অনেকাংশে টিকে আছে। ভবিষ্যতে যাত্রীসেবা আরও উন্নত হবে।
উল্লেখ্য, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রথম ও দ্বিতীয় টার্মিনালে দিনে ৩০টিরও বেশি উড়োজাহাজ সংস্থার ১২০-১৩০টি প্লেন উড্ডয়ন ও অবতরণ করে। প্রতিদিন এসব উড়োজাহাজের প্রায় ২০ হাজার যাত্রী বিমানবন্দরের দুটি টার্মিনাল ব্যবহার করেন। এ হিসাবে বছরে প্রায় ৮০ লাখ যাত্রীর সেবা দেওয়ার সুযোগ আছে। তৃতীয় টার্মিনাল চালু হলে আরও ১ কোটি ৬০ লাখ যাত্রীকে সেবা দেওয়া সম্ভব হবে বলে জানিয়েছে বেবিচক।
এদিকে উদ্ভোধনের অপেক্ষায় রয়েছে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল। চলতি বছরের শেষ দিকে এই টার্মিনাল উদ্ভোধন হতে পারে। কর্তৃপক্ষ জানায়, টার্মিনাল কার্যক্রমে ব্যবহৃত উপকরণের ক্যালিব্রেশন ও প্রস্তুতির কারণে টার্মিনালটি পুরোপুরি ব্যবহারে কিছু সময়ের প্রয়োজন হচ্ছে। কর্তৃপক্ষ বলছে, থার্ড টার্মিনাল হিসেবে পরিচিতি পাওয়া নতুন এই টার্মিনালের মাধ্যমেই মূলত বাংলাদেশ সনাতনী ধারা বিমানবন্দর পরিসেবা থেকে বেরিয়ে আধুনিক বিমানবন্দর যুগে প্রবেশ করবে। নতুন টার্মিনালটির যাত্রী ক্যাপাসিটি হবে ১ কোটি ৬০ লাখ। তৃতীয় টার্মিনাল পুরোপুরি চালু হলে বছরে ২ কোটি ৪০ লাখ যাত্রীকে সেবা দেয়া সম্ভব হবে বলে আশা করছে কর্তৃপক্ষ। নতুন টার্মিনালে মোট বোর্ডিং ব্রিজ থাকবে ২৬টি। নতুন টার্মিনালে মোট ৩৭টি উড়োজাহাজ পার্কিং করা যাবে। আগের দুটিতে রাখা যেতো ২৯টি উড়োজাহাজ। আগে লাগেজ কনভেয়ার বেল্ট ছিলো দুই টার্মিনাল মিলিয়ে আটটি। আর তৃতীয় টার্মিনালে এ ধরণের বেল্ট আছে ১৬টি। আগের দুটি টার্মিনালে মোট চেক ইন কাউন্টার ছিলো ৬২টি আর ইমিগ্রেশন কাউন্টার ছিলো ১০৭টি। তৃতীয় টার্মিনালে আরও যুক্ত হয়েছে চেক ইন কাউন্টার ১১৫টি আর ইমিগ্রেশন কাউন্টার ১২৮টি।
ফা আ/ এনজি