দেশে বর্তমান অবস্থাকে ‘ভয়াবহ’ অভিহিত করে এর বিরুদ্ধে সকলকে ‘রুখে দাঁড়ানো’র আহ্বান জানিয়েছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
মঙ্গলবার (১৫ জুলাই) দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবে এক অনুষ্ঠানে কোটা বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপরে ছাত্র লীগের হামলার ঘটনাসহ দেশের অবস্থা তুলে ধরে বিএনপি মহাসচিব এই আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, ‘‘ আজকে দেশের অবস্থা ভয়াবহ পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে আইনের শাসন নেই, গণতন্ত্র নেই, এখানে মানুষের ন্যায় বিচার পাওয়ার অধিকার নেই, এমনকি কথা বলার কোনো অধিকার নেই। এখন কঠিন সময় আমরা অতিক্রম করছি। এই সময়ে যদি আমরা রুখে দাঁড়াতে না পারি তাহলে পুরো দেশ ও জাতির অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়বে।”
‘‘ আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, এদেশের মানুষ ওরা জেগে উঠছে। আমি বিশ্বাস করি যে, জনগন তাদের অধিকার আদায় করে নেবে। যে কথাটা মাহমুদুর রহমান মান্নাসহ সকল নেতারা বলেছেন যে, আর সময় দেয়া যাবে না। সকলকে উঠে দাঁড়াতে হবে, রুখে দাঁড়াতে হবে…অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আমাদের অধিকার আমাদের আদায় করে নিতে হবে।”
জাতীয় প্রেসক্লাবের আবদুস সালাম হলে ভাসানী অনুসারী পরিষদের উদ্যোগে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান যাদু মিয়ার শততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এই আলোচনা সভা হয়। যাদু মিয়া বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন।
‘ফ্যাসিবাদ কি চোখে দেখলাম’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘‘ আমরা বরাবরই বলছি, আওয়ামী লীগ আর সেই আওয়ামী লীগ নেই। আওয়ামী লীগ এখন একটা দেউলিয়া রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছে। আওয়ামী লীগের সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে আমলাদের ওপরে এবং তাদের তথাকথিত বাহিনীর উপরে যারা আজকে রাষ্ট্রকে পুরোপুরিভাবে একটা ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করেছে।”
‘‘ ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে আমার ধারণা বই পড়ে… বিভিন্ন ভাবে কিন্তু কোনো ধারণা ছিলো না। কালকে(সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা আন্দোলনকারীদের ওপরে ছাত্র লীগের হামলার ঘটনা) আমার মনে হয়েছে যে, আমি ফ্যাসিবাদ দেখেছি। আমি আমার চোখের সামনে দেখেছি যে, যখনই কোনো কিছু দমন করতে হলে বিরোধী দলকে,বিরোধী মতকে, এমনকি ছাত্রদের দাবিগুলোকে তখন এভাবে তাদের দলের লোকজনকে দিয়ে, তাদের বিভিন্ন সন্ত্রাসীদেরকে দিয়ে তাদেরকে লেলিয়ে দেয়া এবং পুরোপুরিভাবে স্তব্ধ করে দেয়া … এটা হচ্ছে সত্যিকার অর্থেই ফ্যাসিবাদ।”
তিনি বলেন, ‘‘ আজকে সেই অবস্থা থেকে দেশকে বের করে আনতে হবে। আজকে ৫৩ বছর হয়ে গেছে স্বাধীনতার… এই স্বাধীনতার এতোদিন পরে আমাদেরকে যখন আমাদের অধিকার নিয়ে লড়াই করতে হচ্ছে,সংগ্রাম করতে হচ্ছে। যে কোটার কথা ছেলেরা বলছে, এই কোটা তো উনি প্রধানমন্ত্রীই বাতিল করে দিয়েছিলেন। আবার সেটাকেই আদালত দিয়ে সামনে নিয়ে এসে ইস্যু বানিয়ে সেটা ইস্যু তৈরি করা হয়েছে।”
‘‘দুর্ভাগ্য আমাদের দেশের আদালতকে ব্যবহার করা হচ্ছে তাদের শাসনকে স্থায়ী করার মধ্য দিয়ে… এই কথা আমরা বহুবার বলেছি। সেজন্য আমাদেরকে বিভিন্নভাবে কথা বলা হয়েছে।”
‘ওরা পাকিস্তানিদের মতো দমন করছে’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘‘ গত একদিনে শেখ হাসিনার সরকার যে ঘটনাটি ঘটিয়েছে এটা বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে জঘন্যতম ঘটনা। আমরা আগে কখনো দেখিনি হাসপাতালের ভেতরে গিয়ে সরকারি দলের সন্ত্রাসীরা আহতদের আক্রমন করবে… এটা আমরা কখনো চিন্তাও করতে পারি না, এমনকি পাকিস্তান আমলেও…।তিনি(শেথ হাসিনা) বলেছেন, পাকিস্তান আমলে হানাদার বাহিনীর কথা নাকি ছেলেরা ভুলে গেছে।”
‘‘ আপনি তো ভুলে যেতে সাহায্য করছেন না বরং আপনারা নতুন করে মনে করে দিচ্ছেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যে আক্রমণ ছিলো সেটা থেকে আপনারা কোন অংশ কম করেছেন। আমরা যখন ঢাকা বিশ্বিদ্যালয়ে পড়ি… তখন ছিলো এনএসএফ আইয়ুব খানের দলের ছাত্র সংগঠন…. তারা এভাবে আমাদের আক্রমন করতো, আমাদের সভা ভঙ্গ করতো, অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে আমাদের সমস্ত আন্দোলনকে দমন করতে শক্তি প্রয়োগ করতো। আজকে আপনারা সেই পাকিস্তানিদের মতো একইভাবে সাধারণ ছাত্রদের ন্যায়সঙ্গত দাবি যে যৌক্তিক দাবি, সেই দাবির আন্দোলনকে নসাৎ করে দেয়ার জন্য আজকে তাদের ওপরে অস্ত্র-সস্ত্র হাতে নিয়ে আপনাদের সেই বাহিনীকে আপনারা লেলিয়ে দিয়েছেন। এভাবে ভয়াবহ নির্যাতন করে তাদেরকে দমানোর চেষ্টা করছেন।”
‘মূল দাবিকে পাশ কাটাতে নানা কৌশল’
মির্জা ফখরুল বলেল, ‘‘ একটা জিনিস লক্ষ্য করবেন মূল যে দাবি জনগণের যে একটা সুষ্ঠু অবাধ নির্বাচন চাই ,গণতন্ত্রকে ফেরত চাই, ভোটের অধিকার ফেরত চাই এই দাবিগুলো পাশ কাটানোর জন্য তারাই(সরকার) একটার পর একটা ঘটনা ঘটিয়ে তারাই ঘটনা ঘটিয়ে তারা জনগণের যে দৃষ্টি শক্তিকে বিভ্রান্ত করতে চায়।”
‘‘ আমাদের জনগণের মূল যে সমস্যা সেই সমস্যাটা হচ্ছে, আমরা সুষ্ঠু জবাবদিহিমূলক সরকার চাই, ব্যবস্থা চাই যে ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে মানুষের কথা বলার অধিকার থাকবে, যারা ক্ষমতায় থাকবেন তারা জবাবদিহি থাকবেন … এই বিষয়গুলো ব্যবস্থা থাকবে সেখানে জনগন তার কথা বলতে পারবে।”
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘‘ লজ্জা হওয়া দরকার তার… এই মহিলা কিভাবে প্রধানমন্ত্রী থাকেন। তারপরে তার চাইতে দূঃখজনক হচ্ছে যে, তিনি এবং তার চামচা যারা তারা সবাই বলছেন, এই যে যারা শ্লোগান দিচ্ছে… ‘আমি কে তুমি কে, রাজাকার রাজাকার’… মানে নিজেদেরকে রাজাকার বলছে না।”
‘‘ প্রধানমন্ত্রী তাদেরকে রাজাকার বলছেন, তাই বিদ্রুপ করে বলছে, তিনি বলেছেন আমাদেরকে রাজাকার। পাল্টা শ্লোগান দিচ্ছে, তুই রাজাকার, তুই রাজাকার। এটাই ঠিক, এইটাই ঠিক এই রাজাকার আর মুক্তিযোদ্ধার তকমা নিয়ে দেশ শাসন করবার চেষ্টা করেছেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে সারা দেশকে নৃশংসভাবে শোষন, দমন-নিপীড়ন করবার চেষ্টা করছেন এই ছাত্ররা তার বিরুদ্ধে জেগেছে।”
কোটা আন্দোলকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলায় গুরুতর আহতদের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘‘ হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আমার আপনার সন্তানরা শিক্ষার্থীরা রক্তাক্ত আহ্বান করেছে… ’১৮ সালেও যখন আন্দোলন হয়েছিলো তখন কোটায় যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন তারা বলেছিলো, উনার মধ্যে আমি মায়ের ছবি দেখি। সামনে তাদের ছবি দিয়ে মিছিল করেছিলো… বঙ্গবন্ধুর বাংলায় বৈষম্যের ঠাই নেই। মাইরের চোটে সোজা হয়ে গেছে… যখন আন্দোলন শেষ হয়েছে।”
‘‘ আর এখন যারা আন্দোলন করছে তারা দুইদিনের মধ্যেই সরাসরি ঘোষণা করেছে, তুমি রাজাকার্। আর সমস্ত বাংলার জনগনের কাছে, বুদ্ধিজীবীদের কাছে যারা লেখে, চিন্তা করে, যারা মানুষকে ভালোবাসে, দেশকে ভালোবাসে তাদের কাছে আবারো বলি, হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে রক্তাক্ত শিক্ষার্থীরা আমাদের কাছে বলেছেন, আমাদের রক্ষা করেন, আমাদের পাশে দাঁড়ান এই আন্দোলনের সাথে থাকেন। এটাই আজকে বাংলাদেশের আবেদন… এই স্বৈরাচারকে যদি উৎখাত করতে হয়, এই নৃশংস শাসনের যদি অবসান করতে হলে তাহলে তার সাথে দাঁড়াতে হবে আমাদের সবাইকে আমাকে আপনাকে প্রত্যেককে এই লড়াইয়ের মধ্যে অংশ নিতে হবে।”
ভাসানী অনুসারি পরিষদের আহ্বায়ক শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলুর সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় জাতীয় পার্টির(কাজী জাফর) মোস্তফা জামাল হায়দার, নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না, বিএনপির বরকত উল্লাহ বুলু, মোহাম্মদ শাহজাহান, নুর মোহাম্মদ খান ও ঢাকা বিশ্ববি্দ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক মাহবুবউল্লাহ প্রমূখ বক্তব্য রাখেন।
এসএম/ এনজি