মোহাম্মদ জাফর ইকবাল
২৬ আগস্ট ২০২৪
স্মরণকালের ভয়াবহ চলমান বন্যায় ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন এক কোটিরও বেশি মানুষ। এদের মধ্যে ৫০ হাজারের অধিক মানুষ একবারে নি:স্ব হয়ে গেছেন। যাদের অনেকেরই নতুন করে সব কিছু শুরু করতে হবে। এবার বন্যায় অতীতের চেয়ে ক্ষয়ক্ষতি অনেক বেশি হয়েছে। বাড়ি ঘর, ফসলের ক্ষেত ভেসে গেছে। ভেসে গেছে গবাদি পশু। পানিবন্দি অবস্থায় দিনাতিপাত করছেন দেশের ১১ জেলার ১৫ লক্ষ পরিবার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবার অন্যতম কারণ হচ্ছে, এভাবে বন্যা সম্পর্কে ধারণা না থাকা। তারা বলছেন, এবার যেসব এলাকায় বন্যায় ভয়াবহ রূপ নিয়েছে, এসব এলাকার লোকজন স্বাধীনতার পরে এমন ভয়াবহতা দেখেনি। ফলে আগে থেকে কোনো প্রস্তুতি না থাকায় ক্ষতির পরমাণ সবচেয়ে বেশি হয়েছে। ভয়াবহ এ বন্যায় ক্ষতির পরিমাণ এখনো নির্ধারণ করা না গেলেও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতি পরিবার প্রতি ক্ষতির পরিমাণ নূন্যতম ৭ লাখ থেকে সব্বোচ্চ দশ থেকে ২০ লাখ টাকা। এছাড়া কৃষি, পানি সম্পদ, সড়কসহ অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতি তো রয়েছেই।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব কামরুল হাসান বলেছেন, এবারের বন্যা ছিল অতীতের থেকেও ব্যাপক। এবারের বন্যায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন ১০ লাখ ৪৭ হাজার ২৯ পরিবার। আর এ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ৫২ লাখ মানুষ। ত্রাণ সচিব কামরুল হাসান জানান, ১১টি জেলার ৭৩ উপজেলা ইউনিয়ন-পৌরসভা ৫৪৫ বন্যা প্লাবিত এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পানিবন্দি ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য ৩ হাজার ৬৫৪টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে এবং আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে ৪ লাখ ১৫ হাজার ২৭৩ জন লোক এবং ২২ হাজার ২৯৮টি গবাদিপশুকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। ১১ জেলার ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য ৭৪৮টি মেডিকেল টিম চালু রয়েছে।
জানা গেছে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিবের এ পরিসংখ্যান থেকেও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি। স্থানীয়ভাবে কাজ করা এনজিও ও স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছেন, ১১ জেলার অধিকাংশ পরিবারই চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। একটি পরিবারও বাকি নেই, যারা ্কষতির মধ্যে পড়েনি। তারা বলছেন, এসব জেলার মানুষ জানতো না বন্যা সম্পর্কে। ফলে আকস্মিক বন্যাতে তাদের কোনো প্রস্তুতিই ছিল না। কেউই কোনো কিছু সরাতে পারেনি। সবকিছু তলিয়ে গেছে বন্যার পানিতে। ঘরে সব কিছু রেখে ভয়ে সরে গেছেন অন্যত্র। ব্র্যাকের হিসাব বলছে এই বন্যায় এখন পর্যন্ত ৮০ লাখ মানুষ ক্ষতির মুখে পড়েছেন। ৪৫ লাখ মানুষ নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন।
চলমান বন্যায় গবাদিপশু ও হাঁস- মুরগির খাদ্য এবং অন্যান্য পশুখাদ্য বিনষ্টসহ এই খাতে এখন পর্যন্ত আনুমানিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা বলে জানিয়েছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার। গতকাল আকস্মিক বন্যায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ উপলক্ষ্যে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টার ব্রিফিং শেষে তিনি বলেন, দেশের ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি চাহিদা পূরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র্য বিমোচনে মৎস্য খাত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, জাতীয় অর্থনীতিতে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান, রপ্তানি আয় বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন এবং দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতের গুরুত্ব অপরিসীম। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম, সিলেট ও খুলনা বিভাগে সাম্প্রতিককালে আকস্মিক বন্যায় ১২টি জেলার ৮৬টি উপজেলা বন্যা কবলিত হয়। স্মরণকালের ভয়াবহ এ বন্যায় জানমালের ক্ষতিসহ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে ব্যাপক ক্ষতি সাধন হয়। ফলে অনেক গবাদি পশুর মৃত্যু এবং ভেসে যাওয়াসহ অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি হয়। তাছাড়া, গবাদিপশু ও হাঁস- মুরগির খাদ্য এবং অন্যান্য পশুখাদ্য বিনষ্ট হয়। এই খাতে এখন পর্যন্ত আনুমানিক ক্ষতির পরিমাণ দুধ, ডিমসহ প্রায় ৪১১ কোটি টাকা।
তিনি আরও বলেন, একইভাবে মৎস্য খাতেও চট্টগ্রাম, সিলেট ও খুলনা বিভাগের ১২টি জেলার ৮৬টি উপজেলায় আকস্মিক বন্যার কারণে অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত পুকুর/দিঘি/খামারের সংখ্যা ১ লাখ ৮০ হাজার ৮৯৯টি, ক্ষতিগ্রস্ত মাছ ও চিংড়ি পরিমাণ ৯০ হাজার ৭৬৮ টন, ক্ষতিগ্রস্ত মাছের পোনা ও চিংড়ির পোস্ট লার্ভা ৩ হাজার ৭৪৬ লক্ষটি, অবকাঠামোগতসহ মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ৫৩৯ কোটি ৩৬ লাখ টাকা।
ক্ষতিগ্রস্ত মৎস্যচাষিদের জন্য পুনর্বাসন কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, সহজ শর্তে ঋণ প্রদান, বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কতা ব্যবস্থা উন্নয়ন, মৎস্যচাষিদের জন্য বন্যা পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা কার্যক্রম চালানো, মৎস্য খামারগুলোকে সুরক্ষিত করার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত সহায়তা প্রদান করা মুক্ত জলাশয়ে পোনা অবমুক্ত কার্যক্রমের অব্যয়িত অর্থ ব্যয়ে বন্যাকবলিত এলাকার চাষিদের মাঝে পোনা বিতরণ করা যেতে পারে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপণা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে দেশের ১১ টি জেলা এখনও বন্যা প্লাবিত। জেলাগুলো হচ্ছে কুমিল্লা, ফেনী, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, লক্ষ্মীপুর কক্সবাজার, সিলেট মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ। তাদের হিসবে বন্যায় ওইসব জেলায় ১৮ জন নিহত হয়েছেন। জেলাগুলোর ৭৭টি উপজেলা ও ৫৮৭টি ইউনিয়ন পানির নিচে চলে গেছে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সজল কুমার রায় জানান, দেশের ৯টি নদ-নদীর পানি এখনো বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বাকি নদীগুলোর পানি এখন বিপৎসীমার নিচে আছে। গতকাল দেশের অভ্যন্তরে এবং উজানে ভারি বৃষ্টি হয়নি। ফলে নদ নদীর পানি কমছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি আগামী ১৮ ঘণ্টায় বৃষ্টি আরো কমবে। তাতে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি আশা করছি।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ কাজী জেবুন্নেসা জানান, খুলনা, বরিশাল ও নোয়খালী ছাড়া দেশের অন্য এলাকায় বৃষ্টি কমে গেছে। এটা আরো কমবে। আগামী ২৬ আগস্ট পর্যন্ত অল্প কিছু বৃষ্টি হবে। এরপর আর বৃষ্টি থাকবেনা। বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। এই কমার ধারা অব্যাহত থাকবে।
ভয়াবহ এ বন্যার ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে কাজ করছে ব্র্যাক। তাদের হিসাবে এই বন্যায় ৮০ লাখ মানুষ ক্ষতির মুখে পড়েছেন। ৪৫ লাখ মানুষ একেবারেই নি:স্ব হয়ে পড়েছেন। প্রকৃত ক্ষতি এখনই নিরূপণ সম্ভব নয় বলে জানান ব্র্যাকের ডিজাস্টার হিট ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ক্লাইমেট প্রোগ্রামের পরিচালক মো. লিয়াকত আলী। তিনি বলেন, বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতি হিসাব করা যাবে। তবে ধারণা করা যায় বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হবে। তিনি জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এবার স্বাভাবিকের চেয়ে দেশের অভ্যন্তরে অনেক বেশি বৃষ্টি হয়েছে। আর ফেনী নদীর উজানে হলো ত্রিপুরা। সেখানেও স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি বৃষ্টি হয়েছে। সেখানেও বন্যা হচ্ছে। এই দুই মিলিয়ে এবার বন্যা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান বলেন, এবারের বৃষ্টি বা বন্যাসংক্রান্ত বার্তা যথাযথ সময়েই দেওয়া হয়েছিল, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এখানে আকস্মিক বন্যা হয়, পানি দ্রুত নেমেও যায়। কিন্তু এবার যা হয়েছে, তা মারাত্মক। এবার ক্ষয়ক্ষতিও ব্যাপক হয়েছে। বন্যার বিষয়ে প্রাথমিক অনুমানের চেয়ে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তিনি বলেন, বর্ষাকালে উজানের দেশগুলো এবং অবশ্যই ভারতের সঙ্গেও বিভিন্ন নদীর (অন্তত আটটি) পানি সমতলের তথ্য আদান প্রদানের প্রক্রিয়া চলমান আছে। বর্ষাকালে ভারতের সঙ্গে থাকা নদীগুলোর ১৪টি পয়েন্টের তথ্য দেশটির জল কমিশন আমাদের নিয়মিত দেয়। তবে এবার তিন থেকে ছয় ঘণ্টার মধ্যে ঢল নেমে এসেছে। এত অল্প সময়ের মধ্যে এই আকস্মিক বন্যার তথ্য পাওয়া সম্ভব নয়। এর মূল কারণ, ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য। তিনি বলেন, বাংলাদেশের দিক থেকে ভারতের কাছ থেকে প্রস্তাব আছে এ সংক্রান্ত তথ্য পাওয়ার। কিন্তু ভারতের পানি নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর কোনো তথ্য আমরা পাই না। ফলে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও অতি বৃষ্টিতে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোতে ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে।
বন্যাদুর্গত এলাকায় কৃষি খাতে ক্ষয়-ক্ষতির প্রকৃত পরিমাণ দ্রুত নির্ধারণপূর্বক প্রয়োজনীয় সহযোগিতা ও পুনর্বাসনের আহ্বান জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র ও কৃষি উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.)। কৃষি উপদেষ্টা বলেন, প্রধান অগ্রাধিকার হচ্ছে বন্যাদুর্গত এলাকায় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী আমন ধানের উৎপাদন নিশ্চিত করা। বন্যা পরবর্তী পুনর্বাসনকালে কৃষি উৎপাদন নিশ্চিতকরণে কৃষি কর্মকর্তাদের সক্রিয়ভাবে মাঠে থেকে কৃষকদের প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতা করতে হবে। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর রাস্তাঘাট ও অন্যান্য অবকাঠামোর জন্য কৃষি জমিতে পানিবদ্ধতা সৃষ্টি হলে তা নিরসনে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট দপ্তর/বিভাগের সহযোগিতা নিয়ে সাময়িকভাবে রাস্তা কেটে বা সুবিধাজনক উপায়ে জলাবদ্ধতা নিরসনের ব্যবস্থা করতে হবে।
দেশের ১১টি জেলায় ছড়িয়ে পড়া ভয়াবহ বন্যার আঘাতে বিপর্যয়ের চিত্র ধারণা চেয়েও বেশি, যা নিয়ে উপদ্রুত অঞ্চলের পাশাপাশি সারা দেশের মানুষের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। বহু ঘরবাড়ি-অবকাঠামো ধসে যাওয়া, বিস্তৃর্ণ অঞ্চলের ফসলের ক্ষতি এবং ভৌত ও ভার্চুয়াল যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হওয়ার মধ্যে পানিবন্দি লাখ লাখ মানুষের কষ্ট ও হাহাকারের তথ্য আসছে। কিছু এলাকায় পানি নামা শুরু হলেও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নতুন করে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধিরও তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। আবহাওয়া অফিস থেকেও মিলছে না ‘সুখবর’, তারা জানাচ্ছে নতুন করে ভারি বা অতিভারি বৃষ্টিপাত না হলেও আপাতত চলমান ধারার ‘বৃষ্টি কমার সম্ভাবনা নেই’। এ অবস্থায় পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক উদ্যোগ, রাজনৈতিক দল, বেসরকারি সংস্থা ও সংগঠন বন্যা উপদ্রুত অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে। ঘরবাড়ি থেকে ফসলের ক্ষেত- সর্বত্র বন্যার আঘাত, দিশেহারা শত শত গ্রামের মানুষ, উৎকণ্ঠায় কৃষক ও বর্গা চাষি। জীবন বাঁচানোর লড়াইয়ের সঙ্গে সঙ্গে ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তাও তাদের ভাবাচ্ছে। আশ্রয়কেন্দ্র, উঁচু রাস্তা ও অবকাঠামাতে গরু-ছাগল, হাসমুরগির সঙ্গে ‘দলা পাঁকিয়ে’ বসবাস করতে হচ্ছে বন্যাকবলিত অঞ্চলের মানুষের। প্রয়োজনীয় চিকিৎসার সুযোগও নেই। চারদিকে থই থই পানি অথচ সুপেয় পানির তীব্র সংকটে ভুগছে বানভাসি মানুষ।
পানির তোড়ে ঘরবাড়ি ভেসে যায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার মোগড়া ইউনিয়নের খলাপাড়া এলাকার বাসিন্দা নারগিস আক্তারের। ক্ষয়ক্ষতির এমন ভয়াবহ অবস্থা নিয়ে কোনো ধারণা ছিল নাগিস আক্তারের। তিনি বলেন, কোনো জিনিসপত্রই রক্ষা করতে পারি নাই। অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি। পানিতে ঘরের জায়গার মাটি সরে যাওয়ায় নতুন করে এখন ঘরও বানাতে পারব না।
ঘরে বানের পানি ওঠায় হবিগঞ্জ সদর উপজেলার রিচি উচ্চ বিদ্যালয়ে আশ্রয় নেওয়া মো. আব্দুল হাই বলেন, বাড়িঘরে পানি ওঠার পাশাপাশি আমন ক্ষেত তলিয়ে গেছে। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এখন অসহায়ের মতো দিন কাটাচ্ছি।
ফেনীর স্থানীয়রা বলছেন, মুহুরী নদীর বানে ফেনী জেলা যে বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে, ইতিহাসে এমন নজির আর নেই। সম্পদহানির সঙ্গে ফেনীর চার উপজেলার চার লাখের বেশি মানুষ এখন প্রাণ বাঁচানো নিয়ে লড়াই করছে। ভুক্তবোগীরা বলছেন, ঘরের কোনো জিনিসই তারা সরাতে পারেন নি। ফলে দীর্ঘদিনের অর্জন নিমিষেই শেস হয়ে গেল।
পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের (ভারত) সঙ্গে যদি চুক্তি নাও থাকে, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী উজানের দেশ হিসেবে ভারতের পানি ছাড়ার আগে আমাদের জানানোর কথা। কিন্তু এবার সেটি প্রতিপালিত হয়নি। ফলে জনগণ বন্যঅ মোকাবেলার কোনো প্রস্তুতিই নিতে পারেনি।
জানা গেছে, উনিশ শতকে ১৮৪২, ১৮৫৮, ১৮৭১, ১৮৭৫, ১৮৮৫ এবং ১৮৯২ সালে মোট ছয়বার দেশব্যাপী প্রলয়ংকারী বন্যা হয়েছিল। বিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে একুশ শতকের প্রথম দশক পর্যন্ত এ ধরনের বিপর্যয় দেখা গেছে মোট ১৮ বার। এর মধ্যে মহাবিপর্যয়ের বছর জানা যায়। ১৯৭৪ এর বন্যার চেহারা ভয়ানক ছিল। ১৯৮৮ সালের বন্যা আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। দেশের ৮২ হাজার বর্গ কিলোমিটারের (সারা দেশের ৬০ শতাংশ) বেশি এলাকা পানির নিচে চলে যায়। ৫০ থেকে ১০০ বছরে এ ধরনের বন্যা হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। দেশব্যাপী ভারি বর্ষণ এবং একই সময়ে পদ্মা, যমুনা এবং মেঘনার পানিবৃদ্ধি এই মহাপ্লাবনের কারণ ছিল। একই মাত্রার বন্যা দেখা দেয় ১৯৯৮ সালে। তবে এই বন্যারও স্থায়িত্ব ছিল দুই মাস। ২০০৭ সালের বন্যা হয় সেপ্টেম্বর মাসে। কিছুটা দেরি করে। দেশের প্রায় ৬৩ হাজার বর্গকিলোমিটার (৪২ শতাংশ) এলাকা প্লাবিত হয়।
জা ই / এনজি