দুপুর ২:০৮ | শনিবার | ২৪ মে, ২০২৫ | ১০ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২, গ্রীষ্মকাল | ২৫ জিলকদ, ১৪৪৬

ফ্লাইট চলাচল বন্ধ ॥ লোকশানের অজুহাত : এবার স্থায়ী বন্ধ হতে পারে দেশীয় এয়ালাইন্স নভোএয়ার

বিশেষ প্রতিবেদন

 

 

মোহাম্মদ জাফর ইকবাল

০৩ মে ২০২৫

 

এবার স্থায়ীভাবে বন্ধ হতে পারে দেশীয় সম্ভবনাময় এয়ালাইন্স সংস্থা নভোএয়ার। এই আলোচনার মধ্যে শুক্রবার থেকে সংস্থাটির ফ্লাইট চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। কতদিন বন্ধ থাকবে, নাকি একেবারেই বন্ধ হয়ে যাবে, এ বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারেনি নভোএয়ার। কেউ বলছেন, সাময়িক বন্ধ থাকবে। আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, এয়ারলাইসটি একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, সংস্থাটি প্রায় দেড়শ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। যদি এয়ারলাইন্সটি চালু থাকে তাহলে বকেয়া আরও বাড়বে।

নভোএয়ার সূত্র গণমাধ্যমে জানিয়েছে, সাময়িকভাবে ফ্লাইট চলাচল বন্ধ করা হয়েছে। কারণ সংস্থাটি তাদের বহরে থাকা পাঁচটি এটিআর বিমান বিক্রির প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এই প্রক্রিয়াটি এই মাসেই সম্পন্ন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। শুক্রবার থেকে বিমান বিক্রির ইনসপেকশন শুরু হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ২০ এপ্রিল থেকে তারা টিকেট বিক্রি বন্ধ করে দেয়। এটা প্রচার হবার পর আবারও টিকেটি বিক্রি চালু করে।

শুক্রবার থেকে আবারো ফ্লাইট চলাচল বন্ধ রয়েছে। অনলাইনে টিকেট কেনার অপশনটিও বন্ধ রয়েছে সংস্থাটির। এর আগে আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট পরিচালনার জন্য তাদের বহরে থাকা উড়োজাহাজগুলো বিক্রি এয়ারবাসসহ আরও উড়োজাহাজ কেনার কথা জানিয়েছিলো নভোএয়ার। তবে তারা বর্তমানে অর্থ সংকটে ভুগছে। এখনো নতুন বিনিয়োগকারীও নিশ্চিত করতে পারে নি। এটা নিয়ে আলোচনা চলছে। বিনিয়োগকারী না পেলে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। মূলত অর্থ সংকটেই বন্ধ হয়ে যেতে পারে সম্ভবনাময় এয়ালাইন্সটি। এছাড়া তাদের বহরে থাকা ৫টি বিমান বিক্রি হয়ে গেলে নতুন বিমান না আসা পর্যন্ত বন্ধ থাকবে ফ্লাইট চলাচল।

বর্তমানে নভোএয়ার ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সিলেট, যশোর, সৈয়দপুর এবং রাজশাহীতে প্রতিদিন অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট পরিচালনা করে। যাত্রী সংকটের কারণে গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে তাদের একমাত্র আন্তর্জাতিক রুটে কলকাতার ফ্লাইট স্থগিত করা হয়েছে। সংস্থাটি বলছে, নভোএয়ার তার পরিকল্পনা অনুযায়ী এগুতে পারছে না। বিমান বহর ও আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের পরিকল্পনা থাকলে বিশ্বে লিজ নেয়ার জন্য বিমানের ঘাটতি রয়েছে। এছাড়া বড় বড় বিমান সংস্থাগুলোর প্রতিযোগীতার কারণে বিমান কেনা কঠিন হচ্ছে।

এর আগে নভোএয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মফিজুর রহমান গনমাধ্যমে বলেছেন, খুব শিগগিরই নভোএয়ারের বোর্ডে একজন বিনিয়োগকারী যুক্তি হবেন। তার সঙ্গে আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। তিনি বলেন, যদি আমরা নতুন বিনিয়োগকারী পাই, তাহলে আমরা বিদেশি ক্রেতাদের কাছে আমাদের বিমান বিক্রি করব না। সেক্ষেত্রে, আমাদের ফ্লাইট বন্ধ হবে না। অন্যথায়, আমাদের তিন মাসের জন্য ফ্লাইট কার্যক্রম বন্ধ রাখতে হবে। তবে, বিমান সংস্থার কর্মী এবং কর্মকর্তারা এই তিন মাসে স্বাভাবিক বেতন পাবেন।

তিনি আরও বলেন, ২০১৩ সালের ৯ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠার পর থেকে, নভোএয়ার বিমান অধিগ্রহণে ৫০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি এবং অবকাঠামো ও সহায়ক সরঞ্জামে অতিরিক্ত ১০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। ২০১৮-১০১৯ অর্থবছর ছাড়া বিমান সংস্থাটি প্রতি বছরই লোকসান করেছে। মহামারির কারণে বিমান সংস্থাটির উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হয়েছে এবং ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দাম বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসায় বিরুপ প্রভাব পড়েছে। এছাড়া, সঙ্কুচিত অভ্যন্তরীণ বাজার এবং চাহিদা হ্রাস চ্যালেঞ্জ আরও বাড়িয়ে তুলেছে।

বিমান বিশেষজ্ঞদের মতে, গত ২৫ বছরে কমপক্ষে আটটি বেসরকারি বিমান সংস্থা তাদের কার্যক্রম বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থার ত্রুটি, অতিরিক্ত শুল্ক, উচ্চ জেট জ্বালানির দাম, রাষ্ট্রীয় ক্যারিয়ার বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের অযৌক্তিক পৃষ্ঠপোষকতার কারণে বাংলাদেশের বিমান শিল্পের বিকাশ সম্ভব হয়নি। তিনি বলেন, পরিস্থিতি একই থাকলে, বিমান সংস্থাগুলো আসবে এবং যাবে। তারা ১০ থেকে ১৫ বছর ধরে টিকে থাকতে পারে কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের বেরিয়ে যেতে হবে।

বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মঞ্জুর কবির ভূইয়া এ প্রতিবেদককে বলেন, নভোএয়ারের ফ্লাইট চলছে না। এ বিষয়ে তাদের কর্তৃপক্ষের সাথে কথা হয়েছে। তারা বলছে অর্থনৈতিক কারনে বন্ধ রাখা হয়েছে। ২ সপ্তাহ পর আবার অপারেশনে আসবে। অর্থনৈতিক সমাধান না হলে কি হবে বলা যাচ্ছে না।

জানা গেছে, বিপুল লোকসানের ধাক্কা সামলাতে প্রতিষ্ঠানটির মালিকেরা নভোএয়ার বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছেন। এরই মধ্যে বিদেশি সম্ভাব্য একটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নভোএয়ার বিক্রির বিষয়টি নিয়ে কর্তৃপক্ষের আলোচনা চলছে। সম্ভাব্য বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান বিমান সংস্থাটির উড়োজাহাজগুলো নিরীক্ষা করতে চায়। চলতি মাসেই এই নিরীক্ষার কথা রয়েছে। তাই ফ্লাইট বন্ধ করে দিয়েছে সংস্থাটি।

নভোএয়ারের ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত একাধিক শীর্ষ ব্যক্তি সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিপুল লোকসানে সংস্থাটির কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়ার বদলে প্রতিষ্ঠানটি বিক্রির চেষ্টা করা হচ্ছে। তাতে মালিকেরা যেমন বড় ধরনের লোকসান থেকে বাঁচবেন, তেমনি মালিকানা বদলের পর সংস্থাটি ব্যবসায় টিকে থাকবে। শেষ পর্যন্ত বিক্রির প্রক্রিয়া যদি ব্যর্থ হয়, তবে এটি স্থায়ী বন্ধ করে দেওয়ার বিষয়টি বিকল্প ভাবনায় রয়েছে তাদের। অর্থাৎ নভোএয়ারের ভবিষ্যৎ এখন হয় বিক্রি, নয়তো বন্ধ হয়ে যাওয়ার অবস্থায় রয়েছে।

জানা যায়, বিমান পরিবহনে ব্যবহৃত জেট ফুয়েলের দাম বেড়ে যাওয়ায় কয়েক বছর ধরে দেশীয় মালিকানার বেসরকারি এই বিমান সংস্থার লোকসানের পাল্লা ভারী হতে থাকে। লোকসানের ধাক্কা সামাল দিতে এক-দেড় বছর ধরে দেশি-বিদেশি ক্রেতা খুঁজছিলেন প্রতিষ্ঠানটির মালিকেরা। দেশীয় একজন উদ্যোক্তার সঙ্গে এ নিয়ে কথাবার্তাও হয়েছিল। কিন্তু বনিবনা না হওয়ায় বিক্রির সেই প্রক্রিয়া আর বেশি দূর এগোয়নি। এখন নতুন করে বিদেশি একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিক্রির প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।

নভোএয়ারের হাতে বর্তমানে ৫টি নিজস্ব উড়োজাহাজ রয়েছে। প্রতিটি উড়োজাহাজের আসনসংখ্যা ৭২। এসব উড়োজাহাজ এটিআর মডেলের। প্রধান কার্যালয়সহ দেশজুড়ে নভোএয়ারের বিভিন্ন কার্যালয় ও বিক্রয়কেন্দ্রে প্রায় ৬৫০ জনের কর্মসংস্থান রয়েছে।

প্রতিষ্ঠানটির একটি সূত্র জানায়, বর্তমানে নভোএয়ারের ১৫০ কোটি টাকার ব্যাংকঋণ রয়েছে। এর বাইরেও কিছু দায়দেনা আছে। পাঁচটি উড়োজাহাজসহ অন্যান্য সম্পদ বিক্রি করে সেই ঋণের একটি অংশ পরিশোধ করতে চায় সংস্থাটি। এ মুহূর্তে এটির কার্যক্রম বন্ধ করা হলেও তাতে আইন অনুযায়ী কর্মীদের বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য পাওনা পরিশোধে ৩০ কোটি টাকার মতো লাগবে। এসব দায়দেনা আরও বেড়ে যাওয়ার আগেই কর্তৃপক্ষ ব্যবসা গুটিয়ে নিতে চাইছে। তারা মনে করছে, এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি যে অবস্থায় আছে, তাতে সম্পদ বিক্রি করে দায়দেনার একটি বড় অংশ পরিশোধ করা যাবে। আরও কয়েক বছর ব্যবসা পরিচালনা করলে তাতে লোকসান আরও বাড়বে। তখন যদি সম্পদ বিক্রি করা না যায়, তাহলে দায়দেনা পরিশোধ করা কঠিন হবে।

সূত্র বলছে, বর্তমানে নভোএয়ারের হাতে যেসব উড়োজাহাজ রয়েছে, সেগুলো আগামী কয়েক বছরের মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যাবে। তখন এসব উড়োজাহাজের ক্রেতা পাওয়াও কঠিন হবে। অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানটি যদি তাদের ফ্লাইট পরিচালনা বা ব্যবসা অব্যাহত রাখতে চায়, তাহলে কয়েক বছরের মধ্যে নতুন করে উড়োজাহাজ কিনতে হবে বা ভাড়ায় আনতে হবে। সে ক্ষেত্রে বড় ধরনের বিনিয়োগ লাগবে। লোকসান দিতে থাকা প্রতিষ্ঠানটির মালিকেরা এখন নতুন করে আর এই ব্যবসায় বিনিয়োগে আগ্রহী নন।

সর্বশেষ ২০২০ সালে দেশীয় মালিকানাধীন রিজেন্ট এয়ারওয়েজ বন্ধ হয়ে যায়। এর আগে দেশীয় মালিকানার ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ, জিএমজি এয়ারলাইনসও কয়েক বছর বিমান পরিচালনার পর বন্ধ হয়ে যায়। বেসরকারি উদ্যোগে দেশে গত কয়েক দশকে একাধিক প্রতিষ্ঠান উড়োজাহাজ ব্যবসায় যুক্ত হলেও বেশির ভাগই শেষ পর্যন্ত লোকসানে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে। বর্তমানে নভোএয়ার ছাড়া এই ব্যবসায় রয়েছে ইউএস বাংলা এয়ারলাইনস ও এয়ার অ্যাস্ট্রা। এর বাইরে সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ বিমান অভ্যন্তরীণ কয়েকটি গন্তব্যে ফ্লাইট পরিচালনা করে।

এভিয়েশন খানের সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স মহাব্যবস্থাপক-জনসংযোগ মো. কামরুল ইসলাম  বলেন, একজন এভিয়েশন জনসংযোগবিদ হওয়ার কারণে বাংলাদেশ এভিয়েশনের উত্থান-পতন খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি, যার ওপর ভিত্তি করে পর্যালোচনা করার চেষ্টা করছি। আকাশ পরিবহন ব্যবসায় একটি নতুন এয়ারলাইন্সের আগমনের জন্য প্রায় দু’বছরের ক্ষণ গণনা করতে হয় প্রতিটি এয়ারলাইন্সকে। ঠিক বিপরীত চিত্রও দেখতে পাওয়া যায়, একটি প্রতিষ্ঠিত এয়ারলাইন্সও বন্ধ হওয়ার মিছিলে অংশীদার হতে দু’বছরের কার্যক্রম ফলো করলেও প্রায় সবার একই রকম চিত্র দেখা যায়। তিনি বলেন, বিগত দিনের বন্ধ হওয়া এয়ারলাইন্সগুলোর কিছু নির্দিষ্ট চরিত্র দেখতে পাওয়া যায়। উল্লেখযোগ্য ফ্যাক্টরগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রেগুলেটরি অথরিটির কাছে দেনা হিসেবে বিভিন্ন চার্জ প্রদান না করার অভ্যাস। কারণ বন্ধ হওয়া এয়ারলাইন্স থেকে এখন পর্যন্ত বাকি টাকা উদ্ধারের দৃষ্টান্ত না দেখা। বন্ধ হওয়ার পূর্বে খরচ কমানোকে উপলক্ষ ধরে কর্মচারী-কর্মকর্তা ছাঁটাই যেন নিয়মিত ঘটনা। এয়ারলাইন্সগুলো থেকে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পাওনা না দেওয়ার প্রবণতা। তিনি বলেন, এয়ারক্রাফটের মতো রুট চয়েসেও সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে দেখা যায় এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে। যাত্রী স্বল্পতার অজুহাত তুলে প্রতিনিয়ত শিডিউল ফ্লাইট বাতিল করতে দেখা যায়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এয়ারলাইন্স বন্ধ হওয়ার মিছিল যত দীর্ঘ হবে বাংলাদেশের এভিয়েশন তত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জাতীয় বিমান সংস্থা ছাড়া বেসরকারি বিমান সংস্থার মধ্যে ২৮ বছরে বেশ কয়েকটি এয়ারলাইন্স বন্ধ হয়ে হয়ে গেছে, যা খুবই দুঃখজনক। বর্তমানে চালু থাকলো অন্য দুটি বেসরকারি এয়ারলাইন্স ইউএস-বাংলা, এয়ার অ্যাস্ট্রা। স্রোতের বিপরীতে নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে ইউএস-বাংলা এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে প্রতিনিয়ত। নব প্রতিষ্ঠিত এয়ার অ্যাস্ট্রা প্রায় দুই বছরের অধিক সময় পার করলেও সঠিক গন্তব্যে এখনো যেতে পারেনি।

 

জা ই / এনজি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *