বিকাল ৪:৪৩ | বুধবার | ৩০শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১৭ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, গ্রীষ্মকাল | ১লা জিলকদ, ১৪৪৬ হিজরি

ফেনীতে বন্যা : কোটি টাকার সম্পদ মুহূর্তেই আবর্জনায় পরিণত

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক  ফেনী থেকে

০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪

এভাবেই নিজের অবস্থা জানাচ্ছিলেন ফেনীর সোনাগাজী থানা উপজেলার ভোর বাজারের পোল্ট্রি ব্যবসায়ী জাফর উদ্দিন। বন্যা যেদিন শুরু হয় সেদিনের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, রাত ৩টার পর পানির চাপ আসছে। মুহূর্তে পুরো এলাকা ডুবে যায়। জীবন নিয়ে ব্যস্ত, সম্পদ বাঁচানোর সুযোগ হয়নি। আমার মতো বহু খামারির পথে বসার দশা। ঘুরে দাঁড়াতে প্রয়োজন সরকারি ও বেসরকারি সহায়তা।

জানা গেছে, বন্যায় সবার মতো ফেনীর খামারিদের মাথায় হাত। তাদের বোবা-কান্না বোঝার সাধ্য নেই সবার। একদিকে ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত, আরেক দিকে কোটি কোটি টাকার সম্পদের ক্ষতি। বিশেষ করে, কোম্পানির পাওনা পরিশোধ ও ব্যাংকের ঋণ নিয়ে তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ। স্মরণকালের ভয়াবহ ও আকস্মিক বন্যা প্রথমদিকে জীবন বাঁচানোর লড়াই থাকলেও এখন ঘুরে দাঁড়ানোর চিন্তা তাদের।

সরেজমিনে দেখা গেছে, বন্যায় চরম ক্ষতিগ্রস্ত জেলা ফেনী। জেলার বেশ কয়েকটি উপজেলা এখনো পানিবন্দি। তবে কিছু উপজেলার পানি নেমে গেছে। ফুটে উঠছে দগদগে ক্ষতের চিহ্ন। মানুষের ঘরবাড়ি থেকে শুরু করে সব কিছুই ক্ষতিগ্রস্ত। যার প্রকৃত চিত্র তুলে আনা প্রায় অসম্ভব। দেশের আমিষের বড় অংশের যোগান দেন যে খামারিরা, তাদের আজ পথে বসার উপক্রম।

সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ফেনী জেলার মোট ৬টি উপজেলায় ৩৯টি ইউনিয়ন ও পৌরসভা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হাঁস-মুরগির খামার ১ হাজার ৮২৭টি। এগুলোর আর্থিক ক্ষতি ৪১ কোটি ৩৮ লাখ ৪৯ হাজার ৫৫০ টাকা।

কোটি টাকার সম্পদ মুহূর্তেই হয়ে যায় আবর্জনা                           মরা মুরগি ফেলা হয়েছে ডোবায়, গন্ধে টেকা দায়

৩ সেপ্টেম্বর জেলার সোনাগাজী উপজেলা ঘুরে দেখা যায়, বেশিরভাগ এলাকাজুড়ে খামার। দু-চারটি বাড়ি পার হলেই চোখে পড়ে মুরগির খামার। তবে কোনো মুরগি নেই, খাঁ খাঁ করছে খামারগুলো। মরা মুরগি ফেলা হয়েছে আশপাশে। ফলে গন্ধে দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম।

সোনাগাজীর ভোর বাজার এলাকায় কথা হয় ‘ভোর বাজার পোল্ট্রি সেন্টার’র মালিক জাফর উদ্দিনের সঙ্গে। তার অফিস ঘরে কোমর-সমান পানি উঠেছে। খামারগুলোতে কোথাও বুক-সমান, কোথাও কোমর-সমান পানি ছিল।

খামারি আমার কাস্টমার। সবাই আমার কাছ থেকে বাচ্চা, ফিড ও ওষুধ নেন। সবার একই অবস্থা। যারা বাড়িঘর বা ছাদে মুরগি নিয়েছেন, বাঁচাতে পারছেন। আমার হিসাবে প্রায় ১ লাখ ১৬ হাজার ডিম নষ্ট হয়েছে। যার দাম প্রায় ১২ লাখ ৭৬ হাজার টাকা। এছাড়াও নিজের ও অধীনস্থ খামারের ব্রয়লার ১৪ হাজার ৮৬০টি, সোনালি ৫৪ হাজার ২০০টি এবং লেয়ার ২৬ হাজার ৩৪০টি মারা গেছে।

তিনি বলেন, ভোর বাজারে আমার অফিসের ওষুধ, ডকুমেন্ট, ফ্রিজ নষ্ট হয়েছে। গোডাউনের খাদ্য নষ্ট হয়েছে। মুরগি আর ডিম তো নষ্ট হয়েছেই। ব্রয়লার-সোনালি টেকানো যায়নি। কিছু লেয়ার টেকাতে পারছি, তবে এগুলো খাবার খাচ্ছে, কিন্তু ডিম দিচ্ছে না। এগুলো রেখেও লাভ নেই। আমাদের স্টাফ বিল, ঘরের ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল সবই লস। এগুলো দিয়ে টাকা উঠবে না।

সোনাগাজী উপজেলার লক্ষ্মীপুর গ্রামের রাজু পোল্ট্রি ফার্মে গিয়ে দেখা যায় একই চিত্র। সেখানে বেশ কয়েকটি ঘরে শেড করে তারা ১৫ হাজার লেয়ার মুরগি পালেন। আছে মাছেরও খামার। তার ৬ হাজার লেয়ার মুরগি মারা গেছে। ৩০ হাজার ডিম নষ্ট হয়েছে।

ফার্মটির স্বত্বাধিকারী আবুল কালাম  বলেন, হুট করে রাত সাড়ে ৩টায় পানি ওঠে। বাড়ি থেকে এসে কিছু মুরগি বের করে ওপরে উঠিয়েছি। কিন্তু ওপরে উঠিয়েও বা লাভ কী! একদিন পরে এরা লাফানো শুরু করেছে, পানি নাই, খাবার নাই। এমনিতেই লাফিয়ে মরছে। নিচ থেকে ময়লা পানি দিয়েছি। খাবার কোত্থেকে দেবো? সব রাস্তা পানির নিচে, খাবার আসেনি। এ কারণে এক ভয়াবহ অবস্থায় পড়েছি। যতটুকু পেরেছি বাঁচিয়েছি। অনেক যুদ্ধ করার কারণে কিছু টিকেছে।

ঘুরে দাঁড়াতে প্রয়োজন সরকারি প্রণোদনা

ক্ষতি পুষিয়ে উঠবেন কীভাবে জানতে চাইলে ভোর বাজার পোল্ট্রি সেন্টারের স্বত্বাধিকারী জাফর উদ্দিন বলেন, ‘এই ক্ষতি পোষানোর অবস্থা নাই। সরকার যদি আমাদের দিকে সুনজর দেয়, আমাদের যে লোন আছে, সেগুলোর যদি সুদহার কমিয়ে দেয় বা আমাদের নতুন করে যদি বিনা সুদে ঋণ দেয়, তাহলে ঘুরে দাঁড়াতে পারবো।’

তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত কোনো সরকারি সহায়তা পাইনি। তবে আমাদের লিস্ট করতে বলছে, আমরা সেটা সমন্বয় করে দিচ্ছি।’

যে কোম্পানি থেকে বাচ্চা ও খাবার নেন, তারা সহযোগিতা করছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে জাফর উদ্দিন বলেন, কোম্পানি থেকে থেকে সহযোগিতা ঝুলে আছে।

কোটি টাকার সম্পদ মুহূর্তেই হয়ে যায় আবর্জনা

ব্যাংক ঋণ প্রসঙ্গে জাফর উদ্দিন বলেন, ‘ব্যাংক ঋণ স্থগিত করার সুযোগ দিয়েছে দুই মাস। কিন্তু এরমধ্যে অতিরিক্ত সুদ দিতে হবে। ১ লাখ ২৮ হাজার টাকার কিস্তির জন্য দুই মাসে আমাদের অতিরিক্ত ৬০ হাজার টাকা সুদ দিতে হবে। আমি বলেছি, এটা লাগবে না। আমি যথা সময়ে ঋণ শোধ করবো। এটা কৌশলে মার দেওয়া হলো। হেল্প করার নামে জুলুম করা হলো।’

এ বিষয়ে রাজু পোল্ট্রি ফার্মের স্বত্বাধিকারী আবুল কালাম বলেন, ‘সরকার যদি আমাদের সহযোগিতা করে, প্রণোদনা দেয় বা যে লোন আছে ব্যাংকে, কিছু যদি কিস্তি মাফ দেয়, বা কিছু সুযোগ-সুবিধা দেয়, তাহলে আমরা আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবো। না হয় আমরা শেষ। সব শেষ। আমাদের সব লোনের ওপর। লোন নিয়ে করছি। সরকার কিছু না করলে এই সেক্টরে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ নেই।’

আলোচনার পর্যায়ে সরকারি সহায়তা, চলছে সমন্বয়

সরকারের কর্মকর্তারা কোনো উদ্যোগ নিয়েছেন কি না জানতে চাইলে পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবুল কালাম বলেন, ‘প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তারা লিস্ট চেয়েছেন। আমরা সেটা করছি। সবাই মিলে লিস্ট করে দেবো।’

এ বিষয়ে ফেনী জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মোজাম্মেল হক  বলেন, ‘ক্ষয়ক্ষতির আমরা প্রাথমিক একটা হিসাব নিয়েছি। তবে প্রকৃত হিসাব পেতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে। এখনো ফেনী জেলার বিভিন্ন উপজেলায় পানি আছে। মানুষ পানিবন্দি। তাদের ক্ষয়ক্ষতির হিসাব যোগ হলে আরও কমবেশি হতে পারে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ।’

তিনি বলেন, ফেনীর মোট ৬টি উপজেলায় ৩৯টি ইউনিয়ন ও পৌরসভা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে জেলার খামারগুলোতে বন্যার সময় ৩৬ লাখ ৪৩ হাজার ৪০০ মুরগি ছিল। মারা গেছে ২০ লাখ ৭৪ হাজার ৮১০টি। হাঁস ছিল ৫ লাখ ১২ হাজার ৫৫৪টি। মারা গেছে ১ লাখ ৮৮ হাজার ৪০২টি। মোট ক্ষতিগ্রস্ত খামার ১৮২৭টি। হাঁস-মুরগি মিলিয়ে ২১ লাখ ৮৬ হাজার ২১০টি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। টাকায় এ ক্ষতির পরিমাণ ১১ কোটি ৩২ লাখ টাকা। আর দানাদার খাদ্য নষ্ট হয়েছে প্রায় ৩০ কোটি ৬ লাখ ৪৯ হাজার ৫৫০ টাকার।

খামারিদের বাঁচিয়ে রাখতে সরকারি উদ্যোগ আছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে এই কর্মকর্তা বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ তো হবেই। তবে ধীরে ধীরে হবে। পুরো ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ হবে। তারপর পরিকল্পনা করে ধীরে ধীরে সরকার ব্যবস্থা নেবে। এখন আমাদের কাছ থেকে ক্ষয়ক্ষতির রিপোর্ট চেয়েছে, আমরা দিচ্ছি, এ পর্যন্তই। হয়তো তারা উপর থেকে পরিকল্পনা করছে, কীভাবে তাদের পুনর্বাসন করা যায়!

এসইউজে/এনজি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *