সকাল ৯:১১ | শনিবার | ২৪ মে, ২০২৫ | ১০ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২, গ্রীষ্মকাল | ২৫ জিলকদ, ১৪৪৬

পর্যটন নগরী কক্সবাজার :  সুপেয় পানির তীব্র সংকট, অকেজো হাজারও নলকূপ

এনজি ডেস্ক

 ২৪ মে ২০২৫

চলছে তীব্র তাপপ্রবাহ। মানুষের হাঁসফাঁস অবস্থা। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব দেখাচ্ছে প্রকৃতি। জলবায়ু পরিবর্তনের এই প্রভাব থেকে যেন মুক্তি মিলছে না কক্সবাজারবাসীর। জেলার সর্বত্র দেখা দিয়েছে সুপেয় পানির সংকট।

জেলা শহরসহ ৯ উপজেলার ৭২টি ইউনিয়নের বেশিরভাগ এলাকাতেই দ্রুত নিচে নামছে ভূ-গর্ভস্থ সুপেয় পানির স্তর। জেলার সরকারি প্রায় অর্ধলাখ নলকূপের সোয়া এক হাজার অকেজো হয়ে পড়েছে। পানি উঠছে না আরও প্রায় হাজার খানেক নলকূপে। দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়াসহ উপকূল-সমতলে সংকট একই ধরনের। ভোগান্তি রয়েছে উখিয়া-টেকনাফের আশ্রয় ক্যাম্পেও।

সামনের বর্ষায় বৃষ্টির পানি ধরে রেখে নিত্য ব্যবহার কিংবা পানের ব্যবস্থা করে সংকট মোকাবিলার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। স্থায়ী সমাধানে সারফেস ওয়াটার বা কমিউনিটি মিলে মিঠাপানির জলাধার করার ওপরও গুরুত্বারোপ করছেন সংশ্লিষ্টরা।

তবে, সংকট নিরসনে ঝিলংজায় ২০২০ সালে শুরু হওয়া প্রায় দেড়শ কোটি টাকার ‘ভূ-উপরস্থ পানি শোধনাগার’-ই ভরসা সবার। চলতি বছরের জুন-ডিসেম্বর নাগাদ এ প্রকল্পের সুবিধা ভোগ করা যেতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।

কক্সবাজার পৌরসভার জনস্বাস্থ্য ও প্রকৌশল বিভাগের মতে, কক্সবাজার শহরের বিভিন্ন এলাকায় অসংখ্য অগভীর নলকূপ অকেজো হয়ে পড়েছে। জেলায় সুপেয় পানির স্তর প্রতি বছর ১০-১২ ফুট হারে নিচে নামছে। ১০ বছর আগেও শহরের টেকপাড়া, পেশকারপাড়া, লালদীঘিসহ আশপাশের এলাকায় ১২০-১৫০ ফুটের মধ্যে ভূগর্ভস্থ সুপেয় পানির স্তর পাওয়া যেত। অথচ এখন ৩০০-৪০০ ফুটের বেশি গভীরে যেতে হচ্ছে। গত কয়েক বছরে সাগরতীরের কলাতলী এলাকায় পানির স্তর ১০-১৫ ফুট নিচে নেমেছে। ফলে অকেজো হয়েছে এখানকার কয়েকশ আবাসিক হোটেলের অসংখ্য পানির পাম্প। ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে এমন অবস্থা বলে মনে করছে পরিবেশ সংশ্লিষ্টরা।

জেলার ঈদগাঁও, পোকখালী, গোমাতলী, জালালাবাদ, ইসলামপুর, রামু, পেকুয়া, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, চকরিয়া, উখিয়া, টেকনাফসহ উপকূল-সমতল, উঁচু-নিচু, পাহাড়ি জনপদ সবখানেই সংকট একই ধরনের।

শহরের লালদীঘিরপাড়ের আছাদ কমপ্লেক্সের পরিচালক খোরশেদ আলম বলেন, ‘ভবনে বসানো পাম্প প্রতি বছরই শুষ্ক মৌসুম এলেই সংকটে ফেলছে। এসময় আগের তুলনায় ১৫-২০ ফুট নিচে নামাতে হয় লেয়ার। গত এক দশকের বেশি সময় ধরে লেয়ার সংকটের পাশাপাশি পানিতে আয়রন ও লবণাক্ততার পরিমাণও মারাত্মক বেড়েছে। এতে নষ্ট হচ্ছে ভবনে চালানো পানির লাইন ও কল। শুধু আমরা নয়, আছাদ কমপ্লেক্সের মতো শত শত ভবন-বাড়িতে একই সমস্যায় ভুগছেন শহরবাসী।’

কক্সবাজার ইউনিয়ন হাসপাতালের ব্যবস্থাপক আনোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, ‘শুধু বাসাবাড়ি নয়, কক্সবাজার সদর হাসপাতালসহ শহরের প্রাইভেট হাসপাতালগুলোও লবণাক্ত এবং আয়রনযুক্ত পানি নিয়ে ভুগছে। শহরের আদালতপাড়া থেকে পূর্ব দিকে বিজিবি ক্যাম্প পর্যন্ত বামপাশের কয়েক কিলোমিটার এলাকার বেশিরভাগ এ দুর্ভোগে রয়েছে। নিয়মিত এসব পানি ব্যবহারের ফলে কাপড় নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি চর্মরোগ, চুল পড়ে যাওয়াসহ নানা সমস্যা পোহাতে হয় শহরবাসীকে।’

সুপেয় পানির তীব্র সংকট, অকেজো হাজারও নলকূপকক্সবাজার শহরের লালদিঘীর পাড়ের আছাদ কমপ্লেক্সের অকেজো নলকূপ মেরামতের চেষ্টা করছে কর্তৃপক্ষ। 

 

ঈদগাঁওয়ের ভাদিতলার বাসিন্দা মাস্টার আলী হোছাইন বলেন, ‘এলাকার বেশিরভাগ পরিবার মোটর ও অগভীর নলকূপের পানি ব্যবহার করে। তবে তীব্র গরম শুরুর পর থেকে মোটর ও নলকূপে পানি উঠছে কম। ভোরে অল্প পানি পেলেও ভরদুপুরে ভোগান্তি বাড়ে।’

উপজেলার উত্তর ধূরুং, দক্ষিণ ধূরুং, লেমশীখালী, কৈয়ারবিলসহ বড়ঘোপ ইউনিয়নের প্রায় এলাকার অগভীর নলকূপ থেকে পানি পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানান কুতুবদিয়ার সংমাজকর্মী হাসান মাহমুদ সুজন।

তিনি  বলেন, ‘বিশেষ করে উত্তর ও দক্ষিণ ধূরুং এবং লেমশীখালীর বিভিন্ন এলাকায় এ সমস্যা প্রখর। দ্বীপে বিদ্যুৎ আসার পর অনেক পরিবারে বৈদ্যুতিক মোটর বসেছে। তবে বিভিন্ন জায়গার বেড়িবাঁধগুলো ভঙ্গুর। এগুলো প্লাবিত হয়ে ঢোকা লবণপানিতে বসতভিটা ও পুকুর তলিয়ে যায়। এসব কারণে অগভীর অনেক নলকূপের পানিতে লবণাক্ততা বেড়েছে।’

সূত্রমতে, কক্সবাজার শহরে প্রায় তিন হাজার গভীর ও ৩০ হাজার অগভীর নলকূপ দিয়ে দৈনিক ৩ কোটি লিটার পানি উত্তোলন হচ্ছে। শহরের দুলাখ বাসিন্দা ছাড়াও পর্যটকের চাহিদা মেটায় এ নলকূপগুলো। বর্ষাকালে নলকূপগুলোতে স্বাভাবিক পানি থাকলেও বাকি সময় উচ্চমাত্রায় লবণাক্ত পানি ওঠে বা নলকূপ বিকল হয়ে যায়। শ্যালো মেশিনে পানি তোলা এবং যত্রতত্র পুকুর-খাল-বিল ভরাটের ফলে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টিপাত না হলে পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কক্সবাজার সভাপতি এইচএম এরশাদ বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনে সাগরের পানিতে লবণাক্ততার সঙ্গে বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাও। শহরে পাঁচ শতাধিক আবাসিক প্রতিষ্ঠানে এবং উখিয়া-টেকনাফে আশ্রয় ক্যাম্পে ভূগর্ভস্থ অতিরিক্ত পানি উত্তোলন হচ্ছে। ফলে কক্সবাজারে ক্রমে নিচে নামছে পানির স্তর আর বাড়ছে লবণাক্ততা।

তিনি আরও বলেন, অপরিকল্পিত নগরায়নে খোলা জায়গা ও জলাধার কমে যাওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তরে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, জলাধার বাড়িয়ে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমাতে হবে।

কক্সবাজার নাগরিক ফোরাম সভাপতি আ ন ম হেলাল উদ্দিন জানান, কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় সাধারণত মাটির ৩০-৩৫ ফুট নিচে পানির স্তর স্বাভাবিক থাকে। আবার কিছু এলাকায় সেই স্তর ১৫০-৪০০ ফুটে নেমে গেছে। অনাবৃষ্টি হলে পানির প্রাকৃতিক উৎসগুলোও ক্রমেই শুকিয়ে যায়। সংকট দেখা দেয় জীবন ধারণ এবং চাষাবাদেও। বন, পাহাড়-প্রকৃতি, নদী-খাল-ছড়া, জলাশয় ও প্রাকৃতিক জলাধারগুলো আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হলে এ সংকট দূর হতে পারে।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর কক্সবাজার সূত্র জানায়, শহর ও সমুদ্রতীরবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নামছে। এসব এলাকার হাজারও অগভীর নলকূপ বিকল হয়েছে। কিছু কিছু এলাকার গভীর-অগভীর নলকূপে উঠে আসছে পান অযোগ্য লবণাক্ত পানি। ফলে সুপেয় পানি সংকট বাড়ছে।

ভরসা দেড়শ কোটির শোধনাগার

তবে, এ সংকট নিরসনে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) এবং বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে প্রায় দেড়শ কোটি টাকা ব্যয়ে শহরের ঝিলংজা মৌজায় দুই একরের বেশি জমিতে ২০২০ সালে ‘ভূ-উপরস্থ পানি শোধনাগার’ নির্মাণ প্রকল্প শুরু করে সরকার। দুদফা সময় বাড়িয়ে ২০২৪ সালে শোধনাগারের নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও নানা কারণে তা সম্ভব হয়নি। চলতি বছরের জুন বা ডিসেম্বর নাগাদ এ প্রকল্পের সুবিধা ভোগ করা যাবে বলে আশা করা যায়। পানি শোধনাগার প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষ।

কথা হয় প্রকল্প পরিচালক গোলাম মুক্তাদিরের সঙ্গে। তিনি জানান, শোধনাগারে প্রতি ঘণ্টায় ১০ লাখ লিটার পানি পরিশোধন করা যাবে। সেখান থেকে পৌরসভার লক্ষাধিক মানুষকে পানি সরবরাহ করা হবে। শোধন করা ৪০ লাখ লিটার পানি প্রথমে শহরের গোলদিঘিরপাড়ে টাংকির পাহাড় এলাকার মাদার ট্যাংকে জমা হবে। সেখান থেকে পাঁচ হাজার লিটার করে পানি জেলা স্টেডিয়ামসংলগ্ন এলাকা, দক্ষিণ রুমালিয়ারছড়া, সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্ট এবং বাস টার্মিনাল এলাকায় তৈরি করা ওভার ট্যাংকে (উচ্চ জলাধার) যাবে। সেখান থেকে যাবে উপকারভোগীদের সরবরাহ লাইনে।

সুপেয় পানির তীব্র সংকট, অকেজো হাজারও নলকূপকক্সবাজার শহরের লালদিঘীর পাড়ের আছাদ কমপ্লেক্সের অকেজো নলকূপ মেরামতের চেষ্টা করছে কর্তৃপক্ষ।

 

প্রকল্প পরিচালক আরও জানান, বিদ্যুৎ সংযোগ পেতে দেরি হওয়ায় সরবরাহ লাইনের কাজে দেরি হয়েছে। চলতি বছরের জুন নাগাদ সব লাইন টানা শেষ হলে ডিসেম্বরের মধ্যে পানি সরবরাহ শুরু হতে পারে।

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছে, সুপেয় পানির সংকট নিরসনে ডেনমার্ক সরকারের আর্থিক সহায়তায় ‘কক্সবাজারে জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ মানুষের জন্য অভিযোজনমূলক প্রকল্প’ নামে একটি হাইসাওয়া (হাইজিন, স্যানিটেশন অ্যান্ড ওয়াটার সাপ্লাই) প্রকল্প চালু করা হয়েছে। প্রকল্পের মেয়াদ পাঁচ বছর। এ প্রকল্পের আওতায় পাইপলাইনের মাধ্যমে একটি নলকূপ থেকে ১০০ পরিবারকে সংযুক্ত করা হচ্ছে। বিদ্যুতের বিকল্প হিসেবে বসানো হচ্ছে উচ্চ ক্ষমতার সোলার প্যানেল।

হাইসাওয়ার এমডি নুরুল ওসমান বলেন, কক্সবাজার ঘূর্ণিঝড়প্রবণ এলাকা হওয়ায় সুপেয় পানির সংকট তীব্র। উৎস কম থাকায় মানুষ বাধ্য হয়ে দূষিত পানি পান করে। খরচ বেশি হওয়ায় গভীর নলকূপ স্থাপন অনেকের সম্ভব হয় না। তাদের জন্য হাইসাওয়া কক্সবাজার সদরসহ টেকনাফ, উখিয়া এবং রামুসহ জেলার চার উপজেলার ২১টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভায় প্রায় ৯০০ সুপেয় পানির উৎস এবং পায়খানা নির্মাণ করেছে। এটি ক্রমে বাড়ছে।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী ইবনে মায়াজ প্রামাণিক বলেন, পৃথিবীতে পানির মাত্র ২ দশমিক ৫ শতাংশ মিঠাপানি। এ মিঠাপানির ৩০ দশমিক ১ শতাংশ পানি থাকে ভূ-গর্ভে। বৃষ্টির পানি মাঠ-ঘাট, রাস্তা, জলাশয় ভেদ করে মাটির নিচে জমা হয় ও সারাবছর আমাদের চাহিদা মেটায়। সুক্ষ্ম বালিকণা ভেদ করে মাটির নিচে জমা হয় বলে এ পানি বিশুদ্ধ। কিন্তু দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, দেশে ক্রমাগত ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নেমে যাচ্ছে।

এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, অপরিকল্পিত নগররায়নে বেশিরভাগ এলাকা এখন কংক্রিটের শহর। ফলে মাটি ভেদ করে পানি নিচে পৌঁছাতে পারে না। বৃষ্টির পানি খাল-নদী-নালায় যাচ্ছে আর অল্পবৃষ্টিতেই বন্যা দেখা দেয়। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, পুকুর-লেক বা নদী বৃদ্ধি করে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমাতে হবে। মেরিন ড্রাইভের পাশ ঘেঁষে থাকা ঝরনার পানি সংরক্ষণ করে ব্যবহার উপযোগী করা গেলে সংকট কমানো সম্ভব।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পানিসম্পদ প্রকৌশল বিভাগের এক জরিপে বলা হয়েছে, ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনা না হলে প্রতি বছর ১০ মিটার করে স্তর নিচে নেমে যাবে। অথচ সত্তরের দশকে যেখানে ভূগর্ভস্থ পানি স্তর ভূপৃষ্ঠ থেকে এক মিটারেরও কম গভীরতায় ছিল, বর্তমানে তা সর্বোচ্চ ৭০-৮০ মিটার পর্যন্ত নেমে গেছে।

 

 

সূত্র জাগো নিউজ/ এনজি ডেস্ক

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *