রাত ৯:৩৪ | বুধবার | ৩০শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১৭ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, গ্রীষ্মকাল | ১লা জিলকদ, ১৪৪৬ হিজরি

ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে নানা আলোচনা

বিশেষ প্রতিবেদন

 

মোহাম্মদ জাফর ইকবাল

১৫ জানুয়ারি ২০২৫

মোহাম্মদ জাফর ইকবাল : দ্রুত প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের চাপ বাড়ছে। এরই মধ্যে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য দলগুলো বলছে, দেশের সমস্যা ক্রমশ: বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই সংকট সমাধানে নির্বাচিত সরকারের কোনো বিকল্প নেই। বিশিষ্টজনরাও বলছেন, যত দ্রুত সংসদ নির্বাচন হবে, ততই ভালো। কেননা, নির্বাচিত সরকার ও গণতন্ত্র সুসংহত না হলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে না। ওদিকে গত সোমবার ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদী বলেছেন, দুই দেশের পারস্পরিক সার্বিক সম্পর্ক তখনই স্বাভাবিক হবে, যখন সে দেশে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসবে। বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের রাজনীতিতে নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করেছে।

সূত্র মতে, বিলম্ব না করে চলতি বছরের জুলাই-আগস্টের মধ্যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্ভব বলে মনে করে বিএনপি। তাই এ বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, নির্বাচন কমিশন ও সব রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐকমত্যে আসার আহ্বান জানানো হয় দলটির পক্ষ থেকে। তারা বলছে, অন্তবর্তী সরকার যেসব সংস্কারের কথা বলছে, সেগুলো অল্প সময়েই করা সম্ভব।

এদিকে নির্বাচন নিয়ে বিএনপির ঐকমত্যের আহ্বানকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো। রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা বিএনপির মতো নির্দিষ্ট মাসের কথা না বললেও আগামী ৭ থেকে ৮ মাসের মধ্যে সংসদ নির্বাচন হওয়া উচিত বলে মনে করেন। তারা বলছেন, আগামী নির্বাচন কোনোভাবেই ২০২৫ সালের পরে যাওয়া ঠিক হবে না। সরকারের উচিত দ্রুততম সময়ে আগামী নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করা।

তবে কোনো-কোনো রাজনৈতিক দল মনে করে, নির্বাচন নিয়ে বেশি তাড়াহুড়া না করে সংস্কারকে গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ নির্বাচন নিয়ে তাড়াহুড়া করলে একটা ভুল ও অস্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে। আবার কেউ-কেউ মনে করেন জুলাই-আগস্ট বাংলাদেশে বর্ষাকাল। তাই অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর শুষ্ক মৌসুমে নির্বাচন হওয়া উচিত। কারণ, বাংলাদেশের ইতিহাসে সবসময় এই সময়ে জাতীয় নির্বাচন হয়ে আসছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট পতন ঘটে স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের। বিপুলসংখ্যক মানুষের মৃত্যু এবং রক্তদানের ফসল হিসেবে ৮ আগস্ট গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। সেই সরকারের প্রায় সাড়ে চার মাস পার হয়েছে। সরকার গঠনের শুরু থেকেই বলা হয়েছে, দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার করে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে অন্তর্বর্তী সরকার। তবে শুরু থেকেই দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছিল দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি। পাশাপাশি বৃহত্তম ইসলামী দল জামায়াতে ইসলামী দাবি জানিয়েছিল, প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে যেন নির্বাচনী রোডে পা বাড়ায় সরকার।

বিজয় দিবসে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ২০২৫ সালের শেষ দিক থেকে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে বলে উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে সম্প্রতি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সুস্পষ্ট ঘোষণা দেওয়ার আহ্বান জানান জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান। তিনি বলেন, সরকার নির্বাচনের ইঙ্গিত দিয়েছে। সুস্পষ্ট কথা এখনো বলেনি। সংস্কার দ্রুত এগিয়ে নিন। ক্রমান্বয়ে সুস্পষ্ট ঘোষণাটাও দিয়ে দিন। ঘোষণা হলে মানুষের মধ্যে একটি আস্থা তৈরি হবে।

কয়েকজন নেতা বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার নানা ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। সফল হতে পারছে না। তাই নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করাই হবে তাদের জন্য সম্মানজনক। গণতন্ত্র মঞ্চের শরিক দল বিপ্লবী ওয়ার্কাস পার্টির সভাপতি সাইফুল হক বলেন, আমরা মনে করি, আগামী ৫ থেকে ৭ মাসের মধ্যে নির্বাচন করা সম্ভব। বাকিটা নির্ভর করছে সরকারের সদিচ্ছার ওপর।

বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, যে কোনো রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে বিএনপির মতো রাজনৈতিক দল নির্বাচন চাইতে পারে। তা ছাড়া গণঅভ্যুত্থানের মূল দাবি ছিল সুষ্ঠু নির্বাচন। কারণ, গত ৩ নির্বাচনই হয়নি। তাই মানুষের আকাংক্ষা নির্বাচিত সরকার দেশ পরিচালনা করবে। কিন্তু যেহেতু গত ১৬ বছর অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় ছিল, তারা নির্বাচনী ব্যবস্থা-প্রশাসন সবকিছু ধ্বংস করে দিয়েছে। তাই সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে এগুলো সংস্কার দরকার।

ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব মাওলানা ইউনুছ আহমাদ বলেন, আমরা সবসময় যৌক্তিক সময়ের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলে আসছি। তবে, তাড়াহুড়া করা যাবে না। কারণ তাড়াহুড়া করলে ভুল হবে, একটা অস্বস্তিকর পরিবেশের সৃষ্টি হবে। সংস্কারকে প্রাধান্য দিতে হবে।

খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমদ আবদুল কাদের বলেন, আমরা মনে করি ২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচন হওয়া উচিত। এরপরে যাওয়া একদম ঠিক হবে না। এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ইতিহাস অনুযায়ী নভেম্বর-ডিসেম্বরে শুষ্ক মৌসুমে নির্বাচন হওয়া উচিত হবে।

সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, অনেক আগে থেকেই আমরা নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করার কথা বলে আসছি। গত ৩ জানুয়ারি আমাদের সমাবেশ থেকে ১৫ তারিখের মধ্যে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণার দাবি জানিয়েছিলাম। সেটি তো পার হয়ে গেল। তিনি আরও বলেন, ২৫ সালের পরে কোনোভাবেই নির্বাচন যাওয়া উচিত না।

বাংলাদেশ এলডিপির নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, গত ১৫ বছর যেহেতু স্বৈরাচার সরকার ক্ষমতায় ছিল, তারা নির্বাচন কমিশন-প্রশাসনকে ধ্বংস করে দিয়েছে, সেক্ষেত্রে কিছুটা সময় লাগতে পারে। তবে, সেটা ২ থেকে ৩ মাসের বেশি সময় লাগার কথা না। তাই আমরা মনে করি জুলাই-আগস্টে নির্বাচন হওয়া সম্ভব। এটা নির্ভর করছে সরকারের সদিচ্ছার ওপর।

লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) প্রেসিডেন্ট ডক্টর কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীর বিক্রম বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের এখন মূল বিষয় হচ্ছে একটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য জাতীয় সংসদ নির্বাচন। দ্রুত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা না করলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামা হবে। অলি আহমদ বলেন, আমরা সংস্কার চাই। তবে সংস্কারের কোনো আলামত দেখছি না। গত ৬ মাসে কোনো দুর্নীতিবাজ লুটেরাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেখিনি। আশানুরূপ সংস্কার কাজে অগ্রগতি না হওয়ায় জাতি হতাশ।

সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবি জানান জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার আয়োজিত এক যুব সম্মেলনে তিনি বলেন, ২০২৫ সালের মধ্যে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে হবে। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন ‘সম্ভব’, যদি তারা আংশিক সংস্কার করেন। আমরা মনে করি, তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যেই প্রয়োজনীয় সংস্কার করা সম্ভব। এরপর এ বছরের শেষ দিকে নির্বাচন আয়োজন করবেন, এটিই জাতির প্রত্যাশা ও জামায়াতে ইসলামীর দাবি।

জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার সম্প্রতি গণমাধ্যমের কাছে বলেছেন, বিলম্বে হলেও অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন নিয়ে জনগণকে একটা ধারণা দিয়েছে। সুনির্দিষ্ট না হলেও এর মধ্য দিয়ে নির্বাচনের একটা আউটলাইন পাওয়া গেল। আমরা মনে করি, নির্বাচন পর্যায়ে এই সরকারের একটা অভিযাত্রা শুরু হয়েছে। এটাকে ইতিবাচকভাবেই দেখছি। এখন সরকারের সামনে যে চ্যালেঞ্জগুলো আছে, সেগুলো ফেস করে জনগণকে দেওয়া ধারণার ওপর তাদের দৃঢ় থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, সব সংস্কার এই সরকারের পক্ষে করা সম্ভব হবে না। এটি দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন করতে যে সংস্কারগুলো দরকার, সেগুলো অবশ্যই করতে হবে। দ্রুত সময়ে নির্বাচনমুখী প্রয়োজনীয় সেই সংস্কার করা এবং তাদের ঘোষিত ধারণার মধ্যেই নির্বাচন দেওয়া।

সূত্র মতে, ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে নানা আলোচনা চলছে। শুরু হয়েছে নির্বাচনী হিসাব-নিকাশ। ভেতরে ভেতরে নির্বাচনী প্রস্তুতিতে ব্যস্ত রাজনৈতিক দলগুলো। এসবের মাধ্যমে রাজনীতিতে বইতে শুরু করেছে নির্বাচনী হাওয়া। নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেছেন, আমাদের মূল ফোকাস জাতীয় নির্বাচন। জাতীয় নির্বাচনের আগে একটা রি-অ্যাকশন টাইম দিতে হবে। এমন ইভেন্ট আসা ঠিক হবে না, যা জাতীয় নির্বাচনকে ব্যাহত করে।

আমেরিকা-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এবিসিসিআই) চেয়ারম্যান বিশিষ্ট ব্যবসায়ী গিয়াস আহমেদ বলেন, দেশের অর্থনীতিসহ বিভিন্ন খাতে অস্থিরতা বিরাজ করছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সরকারও সামাল দিতে পারছে না। সরকারের উচিত হবে দ্রুত একটি জাতীয় নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। এ ছাড়া পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলে মনে হয় না। কারণ গণতান্ত্রিক ও নির্বাচিত সরকার ছাড়া দেশের সামগ্রিক দুরবস্থার সমাধান হবে না। নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় থাকলে অনেক দিক থেকেই সংকট সমাধান হয়।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, নির্বাচন নিয়ে সরকারকে খুব বেশি সিরিয়াস দেখা যায়নি। ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনাস্থা দেখা দিয়েছে। সরকার একবার বলছে ২০২৫ সালের শেষে, আবার বলছে ২০২৬ সালের শুরুতে নির্বাচন দেবে। এত লম্বা সময়ের পরও নির্বাচনের সময়টা কনফার্ম করা যাচ্ছে না। সেজন্যই দলগুলোর মধ্যে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। আবার সরকারের কার্যক্রমেও কিন্তু বোঝা যায়নি যে, সরকার নির্বাচন দ্রুত করতে খুব আগ্রহী। অথচ সরকারের উচিত ছিল রাজনৈতিক দল এবং নাগরিকদের বোঝানো যে, তারা দ্রুত নির্বাচন দিতে চায়।

 

 

জা ই / এনজি

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *