সন্ধ্যা ৬:২১ | বুধবার | ৩০শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১৭ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, গ্রীষ্মকাল | ১লা জিলকদ, ১৪৪৬ হিজরি

তিনদিনের মধ্যে আগের প্রজ্ঞাপন বাতিল : রাজউকের চেয়ারম্যান পদে ফের বহালে বড় অংকের অর্থ লেনদেনের অভিযোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক

২২ সেপ্টম্বর ২০২৪

 

 

চুক্তি বাতিলের তিন দিনের মাথায় ফের স্বপদে বহাল হলেন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সদ্য সাবেক হওয়া চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) ছিদ্দিকুর রহমান সরকার। গত ১৯ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব নিলুফা ইয়াসমিন স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করে এ সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল। গতকাল রোববার সেই নিলুফা ইয়াসমিন স্বাক্ষরিত (নম্বর : ০৫.০০.০০০০.১৪৬.০২.০২৩.১৭-৫২৭) প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে পূর্বের বাতিলকৃত প্রজ্ঞাপনটি বাতিল করা হয়েছে।

জানা গেছে, সূত্র মতে, গত ১৯ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার মেজর জেনারেল (অব.) ছিদ্দিকুর রহমান সরকারের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করে এ সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারির পর থেকেই ফের স্বপদে ফিরতে মরিয়া হয়ে উঠে নানা অভিযোগে অভিযুক্ত শেখ হাসিনা সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) ছিদ্দিকুর রহমান সরকার। অভিযোগ ছিল, তিনি বিভিন্ন জায়গায় পদে ফিরতে অর্থ লেনদেনসহ নানা সুযোগ সুবিধার অফার দিচ্ছেন। শেষ পর্যন্ত অর্থের মাধ্যমেই স্বপদে তিনি ফিরে এসেছেন বলে মনে করছেন অভিযোগ কারীরা। তারা বলছেন, একটি দলের শীর্ষ নেতাকে বড় অংকের টাকার বিনিময়ে ম্যানেজ করে তিনি আবারো চেয়ারম্যান পদ ফিরিয়ে এনেছেন। যা রীতিমত মীরাক্কেল বলে মন্তব্য সংশ্লিষ্টদের।

তারা বলছেন, গত ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকার প্রধানের দেশ থেকে পালিয়ে যাবার পর থেকেই পদ হারানোর আতংকে ছিলেন তিনি। সেই হাসিনার প্রিয়ভাজনকেই আবারো রাজউকের চেয়ারম্যান পদে বসানো হলো। নিয়োগ পাওয়ার পরই দুর্নীতি, অনিয়ম, আওয়ামী লীগের লোকজনকে কাজ পাইয়ে দেয়ার সাথে জড়িত বলে অভিযোগ ছিল এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। অফিসে যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার উপর কেউ কথা বলার সাহস পেত না। তার সিদ্ধান্তের বাইরে গেলেই বিভিন্নরকম খড়গ নেমে আসতো। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকেই তাকে সরানোর জন্য রাজউকসহ সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে প্রচন্ড চাপ ছিল। তবে নিজের পদ রক্ষায় সব কৌশল কাজে লাগিয়েও ব্যর্থ হলে ফের স্বপদে বহাল হন ছিদ্দিকুর রহমান সরকার।

গতকাল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব নিলুফা ইয়াসমিন স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মো. ছিদ্দিকুর রহমান সরকার এর নিয়োগের বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ১৯ সেপ্টম্বর তারিখে জারিকৃত (নম্বর : ০৫.০০.০০০০.১৪৬.০২.০২৩.১৭-৫২৫) নং প্রজ্ঞাপনটি বাতিল করা হলো। ২০২৪ সালের ৪ এপ্রিল জারিকৃত নিয়োগের আদেশ বহাল রাখা হলো বলে প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে। জনস্বার্থে এ আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে।

এদিকে নিয়োগ বাতিলের বিষয়টি অনেকটা এড়িয়ে গেলেন ছিদ্দিকুর রহমান সরকার। গতকাল সন্ধ্যায় এ প্রতিবেদক তার স্বপদে ফিরে আসার বিষয়ে জানতে চাইলে উত্তরে বলেন, আমার নিয়োগ বাতিলের বিষয়ে একটি প্রজ্ঞাপনের কথা শুনলাম। আমার নিয়োগ বাতিলের বিষয়টি এখনো শিউর না। তাহলে কি ঝুলন্ত অবস্থায় আছে? জবাবে বললেন, হয়ত এমননি। তার এ বক্তবের পরপরই তাকে স্বপদে বহাল রাখার প্রজ্ঞাপনটি জারি হয়েছে। নতুন প্রজ্ঞাপনের বিষয়ে জানতে ফোন করা হলেও তিনি আর রিসিভ করেন নি।

এদিকে দায়িত্বে থাকা অবস্থাতেই দরপত্র ছাড়াই চেয়ারম্যানের বাংলো সংস্কারে ৮ গুণ বেশি ব্যয় করার অভিযোগ উঠেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশানে ২,৫০০ বর্গফুটের দোতলা একটি বাংলো নির্মাণে ১.৫ কোটি থেকে ২ কোটি টাকার মতো খরচ হয়। কিন্তু রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) চেয়ারম্যানের এমন পরিমাপের একটি সরকারি বাংলো সংস্কারেই খরচ ধরা হয়েছে এরচেয়েও বেশি প্রায় ২ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। বাংলো সংস্কারের কাজ প্রায় ৮০ শতাংশ কাজ শেষ করেছে সংস্থাটি। তবে ব্যয়ের প্রাক্কলনটি এখনও অনুমোদন অপেক্ষায় রয়েছে।

জানুয়ারিতে বাংলো সংস্কারের কাজ শুরু করে রাজউক। তারপর কাজের শেষ পর্যায়ে এসে গত সপ্তাহে ওই বিল ধরে ট্রেন্ডার প্রক্রিয়ার মূল্যায়ন সারসংক্ষেপ তৈরি করেছে সংস্থাটি। যদিও প্রথমে এ কাজের খরচ ধরা হয়েছিল ৩০ লাখ ৯ হাজার টাকা। কিন্তু কাজ শেষে ব্যয় বেড়ে গেছে প্রায় ৮ গুণ।
বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অভ প্ল্যানার্স-এর (বিআইপি) সভাপতি আদিল মাহমুদ খান বলেন, নতুন করে একটি বাংলো তৈরি করতেই ২ কোটি টাকার বেশি খরচ হওয়ার কথা না। সেখানে সংস্কারে ২ কোটি ৮৫ লাখ টাকা ব্যয় ধরা কোনোভাবেই বাস্তবসম্মত না।
রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অভ বাংলাদেশের (রিহ্যাব) এক সদস্যও বলেন, রাজউক চেয়ারম্যানের বাংলোর সমপরিমাপের একটি বাংলো নতুন তৈরি করতে খরচ হয় ১.৫ কোটি টাকা। এরপরে আনুষঙ্গিক কিছু খরচ হয়। সব মিলে ২.৫ কোটি টাকায় সম্পূর্ণ একটি বাংলো সেটআপ করা যায়।

রাজউক সূত্রে জানা যায়, গত ৫ এপ্রিল রাজউক চেয়ারম্যান পদে মেজর জেনারেল (অব.) সিদ্দিকুর রহমান সরকারকে দুই বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি যোগ দেওয়ার পরে ওই বাংলো পরিদর্শনে যান প্রকৌশলীরা। তারপর বাংলোর বিভিন্ন সংস্কার কাজের জন্য ৩০ লাখ টাকার একটি প্রাক্কলন প্রস্তুত করে রাজউকের প্রকৌশল বিভাগ।

সংস্কারের মধ্যে রয়েছে আড়াই হাজার বর্গফুটের দোতলা ভবনের পুরনো জলছাদ অপসারণ করে ড্যাম্প প্রুফিং ও ওয়াটার ট্রিটমেন্ট, চিলেকোঠার ছাদ ও দেয়াল ভেঙে নতুন করে তৈরি, ভবনে প্লাস্টার ও রং করা, দরজার চৌকাঠ, শাটার, জানালার ট্রে ও গ্রিল বদল। তবে ১৭ এপ্রিল ‘আরবান রেজিলেন্স প্রকল্প: রাজউক অংশ’ শীর্ষক প্রকল্পের প্রকৌশলী দল ভবনটি পরীক্ষানিরীক্ষার পর ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করে। তারা ভবনটি ভেঙে নতুন ভবন নির্মাণের সুপারিশ করে।

এ সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে রাজউকের নির্বাহী প্রকৌশলী (বাস্তবায়ন-৪) ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে চেয়ারম্যান বাংলো কম্পাউন্ডে নতুন ভবনের স্থাপত্য নকশা প্রস্তুত করতে রাজউক চেয়ারম্যানের কাছে চিঠি দেন। এরপর ৯ মে রাজউকের প্রস্তাবিত প্রকল্পের পরিকল্পনা, নকশা ও বাস্তবায়নের জন্য স্থাপত্য শাখার প্রধান নগর স্থপতি মোস্তাক আহমেদকে আহ্বায়ক করে ১৩টি প্রকল্পের কমিটি গঠন করা হয়। এর মধ্যে চেয়ারম্যান বাংলোর প্রকল্পের কমিটিও রয়েছে। ওই কমিটি গত ১৫ মে সভা করে। সভায় বরং বাংলোটি সংস্কার করার সুপারিশ করা হয় এবং ৭ দিনের মধ্যে নকশা ও ড্রয়িং দাখিল করতে বলা হয়। পরে দ্রুত প্রাক্কলন প্রস্তুত করে কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে দরপত্রের মাধ্যমে কাজ শেষ করতে বলা হয়। তবে ওই সুপারিশ না মেনে কমিটির আহ্বায়ক মোস্তাক আহমেদ ও সদস্য সচিব রাহাত মুসলেমীনের মৌখিক নির্দেশনায় রুপসা এ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্সের (এনডিএ) মাধ্যমে ভবনটির সংস্কার কাজ শুরু করা হয়।

নিয়ম অনুযায়ী বাংলোর সংস্কার কাজ না হওয়ায় ৬ জুন নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ কাউছার (বাস্তবায়ন-৪) রাজউক চেয়ারম্যানের কাছে বাংলোর চলমান কাজের লিখিত নির্দেশনা, কাজের বিস্তারিত পরিকল্পনা ও নকশার অনুমোদিত কপি চেয়ে চিঠি দেন। এরপর চেয়ারম্যান নির্বাহী প্রকৌশলীকে বাংলোর কাজের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও নকশা সরবরাহ শীর্ষক চিঠি প্রত্যাহারের জন্য চাপ দিতে থাকেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তার চাপে ৯ জুন নির্বাহী প্রকৌশলী চিঠিটি প্রত্যাহার করেন বলে জানিয়েছে রাজউক সূত্র। তবে প্রাক্কলনটি এখনও রাজউকের অনুমোদন পায়নি।

যোগাযোগ করা হলে রাজউকের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ কাউছার এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

কাজের চুক্তি পাওয়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ডেভলোপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স (এনডিএ) বলেছে, তারা শুধু তাদের ওপর ন্যস্ত কাজ করছে। তবে এ প্রকল্পের ওয়ার্ক অর্ডার বা দরপত্রের বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বলতে পারবে।

রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ (চলমান দায়িত্ব) মো. আশরাফুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, বাংলোর সংস্কার কাজ কোন প্রক্রিয়ায় করেছে, সেটি তার জানা নেই। প্রকৌশলী বিভাগ থেকে কাজটি করেছে তো, তাই প্রধান প্রকৌশলী বিষয়টি বলতে পারবেন।
এ বিষয়ে রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী (বাস্তবায়ন) আবদুল লতিফ হেলালীর কাছে জানতে চাইলে তিনি একটি মিটিংয়ে আছেন বলে জানান।
দুর্নীতি বা অনিয়মের বিষয়গুলো অস্বীকার করেন রাজউকের পুনরায় বহাল হওয়া চেয়ারম্যান ছিদ্দিকুর রহমান সরকার। তিনি বলেন, একটি মহল উদ্দেশ্যমূলকভাবে আমাকে হেয় করতে এসব ছড়াচ্ছে। তিনি কোনো ধরণের অনিয়মের সাথে জড়িত নন।

 

 

জা ই /এনজি

 

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *