রাত ৯:৪৬ | বুধবার | ৩০শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১৭ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, গ্রীষ্মকাল | ১লা জিলকদ, ১৪৪৬ হিজরি

জুলাই গণঅভূত্থানের ঘোষণাপত্র ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে মত প্রার্থক্য

বিশেষ প্রতিবেদন

 

মোহাম্মদ জাফর ইকবাল

১৬ জানুয়ারি ২০২৫

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে মত প্রার্থক্য দেখা গেছে। রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য অংশীজনের সঙ্গে অনুষ্ঠিত প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকে এ বিভেদ দেখা যায়। বৈঠকে অংশ নিয়ে গণঅভুত্থানের প্রায় সাড়ে ৫ মাস পর রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিকভাবে জুলাই ঘোষণাপত্রের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বিএনপি। অন্যদিকে এমন একটি মূল্যবান দলিল তৈরির পেছনে কোনো অস্থিরতা, অসংগতি ও সমন্বয়হীনতার প্রয়োজন নেই জানিয়ে ঘোষণাপত্রের খসড়ায় ইসলামী মৌলিক বিষয় বাদ পড়ার কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। তারা বলেছেন, অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাদ পড়েছে। সেগুলোকে ঘোষণাপত্রে যোগ করতে হবে।

আজ বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সর্বদলীয় বৈঠক করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ওই বৈঠক শুরু হয়ে চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত। পরে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন বৈঠক অংশ নেয়া রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃবৃন্দ।

সন্ধ্যায় বৈঠক শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ গণঅভ্যুথানের সাড়ে ৫ মাস পর রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিকভাবে জুলাই ঘোষণাপত্রের কি প্রয়োজন ছিল এই প্রশ্ন তুলে বলেন, ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর আমাদের রাজনৈতিক ঐক্যে যাতে ফাটল না ধরে সেদিকে দৃষ্টি রাখার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছি।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, আমরা সব রাজনৈতিক দল যারা ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত ছিল তাদের সবাইকে নিয়ে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক বক্তব্য দিতে চাই। ফ্যাসিবাদের দোসররা যেন এখন যেকোনো রকমের অনৈক্যের বিজ আমাদের ভেতরে বপন করতে না পারে কোনো সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।

তিনি আরও বলেন, আমাদেরকে প্রধান উপদেষ্টা আহ্বান করেছিলেন, আমরা এসেছি, কথা বলেছি, আমাদের পরামর্শ যা দরকার রাষ্ট্র পরিচালনা হিসেবে এবং বিভিন্ন বিষয়ে সেটা আমরা দিয়েছি।

ঘোষণাপত্র নিয়ে কোনো পরামর্শ ছিল কি না— জানতে চাইলে তিনি বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থান সম্পর্কিত ঘোষণাপত্র নিয়ে কিছু আলোচনা হয়েছে, সব রাজনৈতিক দলের নেতারা তাদের বিভিন্ন পরামর্শমূলক বক্তব্য প্রদান করেছেন। আমরা প্রশ্ন করেছি যে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র আসলেই সাড়ে ৫ মাস পরে কোনো প্রয়োজন ছিল কি না? যদি থেকে থাকে সেটার রাজনৈতিক গুরুত্ব, ঐতিহাসিক গুরুত্ব এবং আইনি গুরুত্ব কী? সেটা নির্ধারণ করতে হবে।

সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এই ঘোষণাপত্রকে কেন্দ্র করে ফ্যাসিবাদ বিরোধী যে ঐক্য সৃষ্টি হয়েছে সেখানে যেন কোনো ফাটল সৃষ্টি না হয় সেখানেও আমাদের লক্ষ রাখতে হবে। যদি কোনো রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক দলিলে পরিণত হয় সে দলিলটাকে আমরা অবশ্যই সম্মান করি। কিন্তু সেটা প্রণয়ন করতে গিয়ে যেন সংশ্লিষ্ট সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তাদের পরামর্শ নেওয়া হয় সেই দিকটা নিয়ে আমরা পরামর্শ দিয়েছি। যেন জাতীয় ঐক্যে কোনো ধরনের ফাটল সৃষ্টি না হয়। আমাদের মধ্যে যেন বিভ্রান্তি সৃষ্টি না হয়।

ঘোষণাপত্র নিয়ে বিএনপির অবস্থান কী ছিল জানতে চাইলে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলিল প্রণয়ন বিষয়ে আমরা আমাদের পরামর্শ দিয়েছি, ইত্যাদি বিষয়ে আমরা কথা বলেছি।
খসড়া নিয়ে কোনো আপত্তি আছে কি না— জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য কোন ধরনের বক্তব্য না দিয়ে চলে যান।

অন্যদিকে সর্বদলীয় বৈঠকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে অংশ নেন চার সদস্যের একটি দল। পরবর্তীতে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক সংষদ সদস্য অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার।

ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, জুলাই ঘোষণাপত্র রচনার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে মতবিনিময়ের জন্য আহ্বান জানানো হয়েছিল। বৈঠক ফলপ্রসূ হয়েছে জানিয়ে মিয়া গোলাম পারোয়ার জানান, জুলাই অভ্যুত্থানের একটি ঘোষণাপত্র প্রয়োজন বলে বৈঠকে সবাই ঐক্যমত্য পোষণ করেছেন। বৈঠকে আমাদের মতামত পেশ করেছি। মোটা দাগে বলতে চাই, উপস্থিত সবাই অভ্যুত্থানের চেতনাকে ধারণ করে ঐক্যের পথে পরিচালনার স্বার্থে একমত হয়েছে। তিনি বলেন, সাবজেক্ট টু সাবজেক্ট আলোচনার পরিবেশ বা সময় ছিল না। তিনি আরও বলেন, অনেক মৌলিক জিনিস এই ঘোষণাপত্রের কাঠামো থেকে বাদ পড়েছে। অনেক আলেম ওলামার ত্যাগের ব্যাপার ঘোষণাপত্রে বাদ পড়েছে। এমন প্রক্রিয়া হওয়া দরকার যেন সব পক্ষ মতামত দিতে পারে। আজকের আলোচনাটি প্রাথমিক। কিছু অসংলগ্নতা আছে এটা অনেকেই তুলে ধরেছেন। আবার আমাদের ডাকা হবে।

তিনি বলেণ, সর্বদলীয় বৈঠকে আমরা আমাদের মতামত পেশ করেছি। মোটা দাগে আলোচলার বিষয়ে বলতে গেলে, প্রথমত জামায়াতে ইসলামীসহ সব রাজনৈতিক দল জাতীয় ঐক্য ধারণ করার জন্য জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র প্রনয়ণ করা হোক, এ বিষয়ে একমত।

তবে ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করতে দু’দিন আগে থেকে সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া খসড়াগুলো অনেকেই সময়মতো পায়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা পরামর্শ দিয়েছি সরকারের এমন একটি মূল্যবান দলিল তৈরির পেছনে কোনো অস্থিরতা, অসংগতি বা সমন্বয়হীনতার প্রয়োজন নেই। ধীরস্থিরভাবে আমাদের এই ঘোষণাপত্র প্রণয়নের জন্য প্রতিটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মতবিনিময় হওয়া দরকার।

মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, আমরা পরামর্শ দিয়েছি, সরকারের এমন মূল্যবান ঘোষণাপত্রের জন্য আরও মতবিনিময় হওয়া দরকার। তবে ঘোষণাপত্রের খসড়ায় অনেক মৌলিক জিনিস বাদ পড়েছে। বাংলাদেশে ইসলামী শক্তি বড় একটি ইসলামী শক্তি, ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে তাদের অস্বাধারণ ত্যাগ, বহু মানুষকে শহিদ করা হয়েছে, নিরীহ-নিরপরাধ নেতৃবৃন্দকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়েছে, গুম করা হয়েছে, ক্রসফায়ার নেয়া হয়েছে- এই সত্য ইতিহাসগুলো ঘোষণাপত্রের কাঠামোয় স্থান পায়নি। ইতিহাস থেকে এমন মৌলিক বিষয়গুলো যেন বাদ না পড়ে আমরা সেগুলো সরকারের দৃষ্টিতে এনেছি। আমরা বলেছি- প্রক্রিয়াটা এমন হওয়া দরকার যাতে সব দলসহ স্টেকহোল্ডাররা মতামত দিতে পারে।

বৈঠকে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার ছাড়াও অন্যদের মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল ও সাবেক এমপি হামিদুর রহমান আজাদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন হেলাল, এহসানুল মাহবুব জুবায়ের উপস্থিত ছিলেন।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকী বলেছেন, সরকারের পক্ষ থেকেই ঘোষণাপত্র তৈরির উদ্যোগ নেয়া উচিত। তবে তাড়াহুড়ো করে এটি তৈরি করা যাবে না। পাশাপাশি ঘোষণাপত্রের আইনি ও রাজনৈতিক দিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে ঠিক করতে হবে। গতকাল সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টার সাথে সর্বদলীয় বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন তিনি।

জোনায়েদ সাকী বলেন, গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট, জন আকাংখার প্রতিফলন ও আগামী বাংলাদেশের দিক নির্দেশনা ইত্যাদি বিষয়গুলো একটি দলিলে সন্নিবেশিত হতে পারে। তবে এর পদ্ধতিগত দিক নিয়ে আমাদের প্রস্তাবগুলো তুলে ধরেছি। সেই অনুযায়ী সরকার একটি কর্মপন্থা ঠিক করবে বলে আশা করছি। তিনি আরও বলেন, ঘোষণাপত্রের জন্য একটি খসড়া কমিটি গঠন করা দরকার। সেই কমিটি সবপক্ষের মতামতকে যুক্ত করে এই দলিলটি তৈরি করবেন। কারণ এটি একটি ঐতিহাসিক দলিল। রাজনৈতিক দলিল হিসেবে সবসময় এটি আমাদের কাজে লাগতে পারে। ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে যেই ঐক্যমত্যের সৃষ্টি হয়েছিল তার ভিত্তিতেই দলিলটি তৈরি হতে হবে।

এদিকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পক্ষে রাজনৈতিক শক্তি, ছাত্র জনতা সবার মধ্যে আরও বেশি আলোচনার ভিত্তিতে ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করার প্রতি সর্বদলীয় বৈঠকে সবাই গুরুত্ব দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল। ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ডাকা সর্বদলীয় বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের তিনি একথা বলেন।

আসিফ নজরুল বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের নেতৃত্বে জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণা পত্র প্রণয়ের বিষয়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় বিএনপি, জামায়াত, হেফাজতে ইসলাম, বামমঞ্চ, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক কমিটিসহ জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সব রাজনৈতিক শক্তি অংশগ্রহণ করেছে।

বৈঠক জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণা পত্র প্রণয়ের বিষয়ে সবাই একমত হয়েছে জানিয়ে আসিফ নজরুল বলেন, সবাই বলেছেন, এ ধরনের একটা ঘোষণাপত্র করার দরকার আছে। তবে এখানে অনেক সাজেশন আসছে, মোটাদাগে হলো- ঘোষণা পত্রে সবার অবদান বলতে হবে, ধারাবাহিকতা উল্লেখ করতে হবে।

ঘোষণাপত্রের রাজনৈতিক নেচার বা লিগ্যাল নেচার কি হবে সেটা স্পষ্ট করতে হবে। বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এই ঘোষণাপত্র আরও বেশি আলোচনার ভিত্তিতে জুলাই গণ অভ্যুত্থানের পক্ষে রাজনৈতিক শক্তি, ছাত্র জনতা, সবার মধ্যে আলোচনা করে সর্বসম্মতিক্রমে এটাকে প্রণয়ন করতে হবে। এটার জন্য যত সময় প্রয়োজন সময় নেওয়া যেতে পারে। তবে এটাও বলছে যাতে অযথা কালবিলম্ব না হয় সেই মতামত দিয়েছে। সবাই ঐকমত্য হয়েছে, আরও নিবিড় পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে এই ধরনের ঘোষণাপত্র হওয়া উচিত। সবাই আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন এই প্রক্রিয়ায় আমরা সফল হতে সক্ষম হবো।

সময়সীমা নিয়ে কোন আলোচনা হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, সব রাজনৈতিক দল ও ছাত্রদের সংগঠনের যারা অংশ নিয়েছে সবাই বলেছেন, ঐকমত্য পোষণ করে সর্বসম্মতিক্রমে একটি ঘোষণা পত্র তৈরি করার জন্য। যত সময় লাগুক তা যেন নেওয়া হয়। তাড়াহুড়ো যেন না করা হয়। অযথা কালক্ষেপণ না করা হয়। এই লক্ষ্য অনেকে প্রস্তাব করছে আলোচনা করার জন্য যাতে একটি কমিটি গঠন করা হয়। আমরা এই প্রস্তাবগুলো দ্রুত বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেবো।

ঘোষণাপত্র নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কোনোরকম দূরত্ব সৃষ্টি হয় নাই। শুধুমাত্র কি পদ্ধতি করা হবে, বিভিন্নরকম মতামত আসছে। সব মতামতকে আমরা স্বাগত জানাই। কোথাও আমরা অনৈক্যের সুর দেখি না-বরং সবাই বলছে এই ঘোষণা যেন সবার মালিকানা থাকে, সেই বিষয়ে বিভিন্ন মতামত আসছে। এমন মতামতে সবার ঐক্য আরও সুদৃঢ় হবে।

ঘোষণা পত্র নিয়ে আরও আলোচনা হবে কিনা, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আলোচনা হতে পারে, কমিটি হতে পারে, ওনাদের (রাজনৈতিক দল) মতামত নিয়ে খুব দ্রুত একটা কর্মকৌশল ঠিক করবো।
তিনি বলেন, আমাদের কাছে সবচাইতে জরুরি ফ্যাসিবাদ বিরোধী জাতীয় ঐক্যকে ধরে রাখা। ফ্যাসিবাদ বিরোধী যে জাতীয় ঐক্য তৈরি হয়েছে জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সেই জাতীয় ঐক্যকে গণ ঐক্যে রূপান্তরিত করে সেটাকে রাজনৈতিকভাবে আমরা যেন সাংস্কৃতিক চর্চা করতে পারি, রাজনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যে নিয়ে আসতে পারি এবং সেই ঐক্যকে ধরে রেখে জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি সেটাই আমাদের জন্য এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

এদিকে জুলাই সনদ ঘোষণার বিষয়ে সর্বদলীয় ঐক্যের সভায় সূচনা বক্তব্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ৫ আগস্টের পুরো অনুভূতিটাই ছিল একতার অনুভূতি। একতাতেই আমাদের জন্ম, একতাতে আমাদের শক্তি। ঐক্যের মাঝে এ সরকারের জন্ম হয়েছে। জুলাই ঘোষণাপত্র ঐক্যবদ্ধভাবে করতে না পারলে উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। ঐক্যবদ্ধভাবে দিতে না পারলে ঘোষণাপত্রের দরকার নেই।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, মাঝখানে ছাত্ররা এসে বলল তারা একটি ঘোষণা দেবে। সেখানে আমাকেও থাকতে হবে। আমি বুঝতে চাইলাম কী ঘোষণা দিচ্ছে। শুনে আমি বললাম এটা হবে না। আমার যাওয়া হবে না, তোমাদেরও করা ঠিক হবে না। তোমরা যদি ৫ আগস্টে ফিরে যেতে চাও সেদিনের পরিপ্রেক্ষিতে যেটা হয়েছিল সেটাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। সেদিনের পুরো অনুভূতি ছিল একতার অনুভূতি। কেউ বলেনি তুমি অমুক, আমি অমুক। কাজেই তোমরা করতে চাইলে সবাইকে নিয়ে করতে হবে। এটা পরিষ্কার। এটা না করলে ঠিক হবে না।

তিনি বলেন, যে একতা দিয়ে তোমরা ৫ আগস্ট সৃষ্টি করেছিলে এটার অবমাননা হবে। তারা খুশি হয়নি আমার কথায়। কিন্তু ক্রমেই তারা বুঝল, ৫ আগস্ট যদি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হয় তাহলে এভাবে করতে হবে। একত্রে করতে হবে। সে কথা থেকেই এ আলাপ শুরু কীভাবে একত্র করা যাবে। আজকের আলোচনাটাও এটাকে কেন্দ্র করে হবে। যেখানে আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে করতে পারবো না তাহলে এটার উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। এটার দরকারও নাই। দরকারটা হলো ওটুকু স্মরণ করে দেওয়া, আপনাকে দেখে আমার সাহস আসে। সবার মনে সাহস আসে। সারা দেশ চমকে উঠবে যে, আমরা জেগে আছি। আমাদের অনুভূতি ভোঁতা হয়ে যায়নি চাঙ্গা আছে। জাতি হিসেবে আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে আছি।

রাজনৈতিক নেতাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, দোয়া করবেন, আমি যতদিন আছি এ একতা নিয়ে থাকব। কাজেই সেই পথে আমাদের চলতে হবে। আমাদের সেই সাহসটা আপনারা দেন যখন আপনাদের সঙ্গে বসি। আজকে খুবই সাহসী মনে হচ্ছে আপনাদের দেখে। ৫ আগস্টের কথা স্মরণ করে যে আমরা একতাবদ্ধভাবে আছি। এখন কীভাবে সেটা মানুষের সামনে প্রকাশ করবো, ৫ আগস্টের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করব সেটাই আসল কাজ। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যদি সর্বসম্মতিভাবে আমরা একটি সিদ্ধান্তে আসতে পারি তাহলে দেশের জন্যও ভালো, আন্তর্জাতিকভাবেও ভালো।

বৈঠকে অংশগ্রহণকারী সবার উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, সবার সঙ্গে দেখা হলে, কথা হলে আমার কাছে খুব ভালো লাগে। মনে সাহস পাই। কারণটা পরিষ্কার। কারণ এ সরকারের জন্ম হয়েছে ঐক্যের মাঝখানে। ঐক্যর দ্বারা এটার সৃষ্টি। তিনি বলেন, যখন আমরা নিজেরা নিজেরা কাজ করি, হঠাৎ দেখি একা পড়ে গেছি আশপাশে কেউ নেই, তখন একটু দুর্বল মনে করি। যখন আবার সবাই একসঙ্গে হন, তখন মনে সাহস পাই যে আমরা একতাবদ্ধভাবে আছি। সবাইকে দেখলে সরকারের মাঝে প্রাণসঞ্চার হয়।

তিনি বলেন, আপনারা দোয়া করবেন, আমি যতদিন আছি এই একতা নিয়েই থাকবো। কাজেই সে পথে আমাদের চলতে হবে। আমাদের সেই সাহসটা আপনারা দেন, যখন আমি আপনাদের সঙ্গে একত্রে বসি। আপনাদের দেখে আজকে খুবই সাহসী মনে হচ্ছে ৫ আগস্টের কথা স্মরণ করে। তিনি উপস্থিত সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, যেহেতু তাড়াহুড়ার মধ্যে এটা করতে হচ্ছিল তাই একটু এলোমেলো হয়ে গেছে। আপনারা মনে কষ্ট নেবেন না। কিন্তু আমরা যে বিষয়টা নিয়ে আলাপ করছি সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদি সর্বসম্মতিক্রমে এ থেকে একটা দেশের সামনে আসতে পারি, সেটা দেশের জন্য ভালো, আন্তর্জাতিকভাবেও অনেক ভালো। সবাই দেখবে যে এই জাতিকে অনেক ঠোকরাঠোকরি করা হয়েছে, কিন্তু সবাই স্থির হয়ে আছে, শক্ত হয়ে আছে। সেটা আমরা সারা দুনিয়া ও দেশবাসীকে জানাতে চাই।

ঘোষণাপত্রের খসড়ায় যা আছে : ১৯৭২ সালের সংবিধান সংশোধন বা প্রয়োজনে বাতিল করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করা হয়েছে আলোচিত জুলাই গণ অভ্যুত্থান ঘোষণাপত্রের খসড়ায়। এই ঘোষণাপত্র গত বছরের ৫ আগস্ট থেকে কার্যকর হবে বলে খসড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে।

জুলাই ঘোষণাপত্রের খসড়ায় এই ভূখণ্ডের মানুষের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যুগের পর যুগ সংগ্রামের প্রসঙ্গ তুলে ধরা হয়। পাকিস্তান আন্দোলনের মাধ্যমে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা অর্জন, ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার কথা তুলে ধরা হয়। এর পরের বিভিন্ন প্রেক্ষাপট তুলে কীভাবে ছাত্র-জনতার উত্তাল গণবিক্ষোভ গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয় এবং প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান, সে প্রসঙ্গও রয়েছে জুলাই ঘোষণাপত্রের খসড়ায়।
খসড়ায় বলা হয়, ‘…আমরা, ছাত্র-জনতা সেই অভিপ্রায়বলে আত্মমর্যাদা, সাম্য ও সামাজিক ন্যায়বিচারের যে আদর্শে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে, সেই আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য সার্বভৌম জনগোষ্ঠী হিসেবে নিজেদের সংগঠিত করিলাম। আমরা, প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদ ভেঙে দেওয়ার আহবান জানাচ্ছি এবং ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও অখণ্ডতা রক্ষার্থে ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের আহ্বান জানালাম। আমরা সুশাসন ও সুষ্ঠু নির্বাচন এবং ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার পুনরাবৃত্তি রোধ নিশ্চিত করার জন্য অন্তর্র্বতী সরকার প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করবে, এই অভিপ্রায় ব্যক্ত করলাম।’

খসড়ায় আরও বলা হয়, ‘আমরা ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচারকে লালন করার দলিল ১৯৭২ সালের সংবিধান সংশোধন বা প্রয়োজনে বাতিল করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করিলাম। আমরা জুলাই গণ–অভ্যুত্থানকালে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক সংগঠিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি লুটপাটের অপরাধগুলোর উপযুক্ত বিচার করা হবে, এই অভিপ্রায় ব্যক্ত করিলাম।’

এতে আরও বলা হয়, ‘আমরা এই ঘোষণা প্রদান করলাম যে ১৯৭২ এবং ১/১১ কালের রাজনৈতিক বন্দোবস্তের পরিবর্তন ঘটানোর জন্য আমাদের একটি নতুন জনতন্ত্র (রিপাবলিক) প্রয়োজন, যা রাষ্ট্রে সকল ধরনের নিপীড়ন, শোষণ ও বৈষম্যর অবসান ঘটাবে এবং এ দেশের তরুণসমাজের প্রত্যাশাকে ধারণ করতে পারবে। আমরা এই অভিপ্রায় ব্যক্ত করিলাম যে এই ঘোষণাপত্রকে উপযুক্ত রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা হবে।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি গত ৩১ ডিসেম্বর ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র প্রকাশ করতে চেয়েছিল। এ ঘোষণাপত্র নিয়ে তখন দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা আলোচনা তৈরি হয়। হঠাৎ ঘোষণাপত্রের বিষয়টি কেন সামনে আনা হলো, এর প্রভাব কী হতে পারে, তা নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন ওঠে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেস উইং তখন এ উদ্যোগের সঙ্গে সরকার সম্পৃক্ত নয় বলে উল্লেখ করেছিল। অবশ্য পরে ৩০ ডিসেম্বর রাতে জরুরি প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব জানিয়েছিলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের একটি ঘোষণাপত্র তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ওই রাতে বৈঠক করে ৩১ ডিসেম্বর শহীদ মিনারে ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ (ঐক্যের জন্য যাত্রা) কর্মসূচি ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। ওই কর্মসূচি থেকে জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়। ওই সময়সীমা শেষ হওয়ার পরদিন গতকাল বৃহস্পতিবার জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও অংশীজনের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে এ বৈঠক হলো।

এর আগে বৈঠকে অংশ নিতে দুপুর থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আসতে শুরু করেন। পরে বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে বৈঠক শুরু হয়। বিকেল ৪টা ৫০ মিনিটে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এসে পৌঁছান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ বেলা ৩টা ২৪ মিনিটে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে প্রবেশ করেন জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার ও সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আজাদসহ জামায়াত পতিনিধি দল। এর কিছুক্ষণের মধ্যে প্রবেশ করেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান ও যুগ্ম মহাসচিব আশরাফুল আলম, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক ও বাসদের (মার্ক্সবাদী) সমন্বয়ক মাসুদ রানা এবং গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক। পৌনে চারটার দিকে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে প্রবেশ করেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। এরই মধ্যে বৈঠকস্থলে প্রবেশ করেন প্রেস সচিব শফিকুল আলম। এসময়ে প্রবেশ করেন রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের হাসনাত কাইয়ুম, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান ও যুগ্ম মহাসচিব ইঞ্জিনিয়ার আশরাফুল আলম, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আহমদ আব্দুল কাদের, বৈষম্য বিরোধী ছাত্রআন্দোলনের আরিফ সোহেল, জাতীয় নাগরিক কমিটির নাসিরুদ্দীন পাটোয়ারি, আখতার হোসেন প্রমুখ। বেলা ৪টা ১৭ মিনিটে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে প্রবেশ করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

 

জা ই / এনজি

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *