নিজস্ব প্রতিবেদক
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
আজ ২১ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার ছিল অমর একুশে ফেব্রুয়ারি, মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। নানা আয়োজনে দিনটি পালন করছে গোটা জাতি।
মাতৃভাষা আন্দোলনের ৭৩ বছর পূর্ণ হলো গতকাল। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে যথাযোগ্য মর্যদায় দিবসটি পালিত হয়েছে। গভীর শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় ভাষা শহীদদের স্মরণ করছে জাতি।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসটিকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও আশপাশের এলাকায় অতিরিক্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মোতায়েন করা হয়েছিল। সাদা পোশাকেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নজরদারি করেছেন।
রাজধানী ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার শুক্রবার প্রথম প্রহরে শুরু হয় এ দিবস পালনের কর্মসূচি। একুশের প্রথম প্রহরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ভাষা শহীদদের প্রতি পৃথকভাবে গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন রাষ্ট্রপতি ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। রাত ১২টার পর প্রথমে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। রাত ১২টা ১২ মিনিটে অন্তর্র্ব্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।
এর আগে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টাকে স্বাগত জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক নিয়াজ আহমদ খান। রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার শ্রদ্ধা নিবেদনের পরে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা, বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকেরা, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দীন, সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ নাজমুল হাসান, বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা জানান।
এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার শ্রদ্ধা জানায়। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ও সিন্ডিকেটের সদস্যরা, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিরা, বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন শ্রদ্ধা জানায়। এরপর সর্বস্তরের জনসাধারণের শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণের জন্য শহীদ মিনার উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। সূর্যোদয়ের পর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ঢল নামে সর্বস্তরের মানুষের।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, ভাষাশহীদরা শ্রদ্ধার পাত্র। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন বাঙালি জাতির হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন তারা। তাদের ভুলে গেলে শহীদদের অবমাননা করা হবে। তিনি বলেন, ৫২-তে যারা লড়াই করেছেন তারা প্রতিষ্ঠিত সরকার ও বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। একইভাবে ২৪-এর আন্দোলনকারীদের অবদানও জাতি স্মরণ রাখবে। মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে শুক্রবার সকালে রাজধানীর পল্টনে জামায়াতে ইসলামীর উদ্যোগে শুরু হওয়া ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প পরিদর্শনে গিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এসব কথা বলেন তিনি।
ভোর সাড়ে ছয়টায় নিউ মার্কেটের কাছে বলাকা সিনেমা হলের সামনে থেকে বিএনপির নেতা-কর্মীদের নিয়ে বিশাল প্রভাব ফেরি আজীমপুর কবরাস্থানে যায় রিজভীর নেতৃত্বে। সেখানে ভাষা শহীদের কবরে পুস্পমাল্য অর্পন এবং ফাতেহা পাঠ করে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আসে বিএনপির প্রভাত ফেরি। নেতা-কর্মীরা কালো ব্যাজ ধারণ করে। রিজভীর নেতৃত্বে শহীদ মিনারের বেদীতে বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে পুস্পস্তবক অর্পন করেন বিএনপির নেতাকর্মীরা।
বাংলাদেশ সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের সদস্যসচিব কাদের গনি চৌধুরী বলেছেন, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ একুশের চেতনারই ফসল। বুধবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বাংলাদেশ সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের পক্ষে পুষ্পস্তবক অর্পণ শেষে সাংবাদিকদের তিনি এসব বলেন। তিনি বলেন, একুশের চেতনা যুগে যুগে জনগণের মৌলিক অধিকার হরণকারী নিষ্ঠুর স্বৈরাচারী শক্তিকে রুখতে উদ্বুদ্ধ করে। যা চব্বিশেও করেছে।
জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে আমরা ৫২, ৬৯, ৭১, ৯০ এবং ২৪-এ জয়লাভ করেছি মন্তব্য করে জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা) সহসভাপতি ও দলীয় মুখপাত্র রাশেদ প্রধান বলেছেন, আওয়ামী অপরাজনীতি এবং ভারতীয় আগ্রাসন রুখে দিতে হবে। সার্বভৌমত্ব রক্ষায় জাতীয় ঐক্যের বিকল্প নেই। বৃহস্পতিবার একুশের প্রথম প্রহরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে তিনি এসব কথা বলেন। পুষ্পস্তবক অর্পণকালে উপস্থিত ছিলেন- জাগপার প্রেসিডিয়াম সদস্য আসাদুর রহমান খান, সাংগঠনিক সম্পাদক আরিফ হোসেন ফিরোজ, ঢাকা মহানগর সদস্য সচিব আশরাফুল ইসলাম হাসু, যুব জাগপা নেতা শ্রী শ্যামল চন্দ্র সরকার, জাগপা নেতা মনির হোসেন, জাকির হোসেন, শ্রমিক জাগপার সদস্য সচিব মনোয়ার হোসেন, জাগপা নেতা সাজু মিয়া, মো. আলী ফকির, যুবনেতা জনি নন্দী, আসাদুজ্জামান নুর প্রমুখ।
যথাযোগ্য মর্যাদায় মহান একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করেছে জাতীয়তাবাদী ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ (জেবিএবি)। এ উপলক্ষে সংগঠনের পক্ষ থেকে সকাল সাড়ে ৮টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন- অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় সদস্য সচিব মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তাক, যুগ্ম আহ্বায়ক রফিকুল ইসলাম ও ইদ্রিস মিয়া, সোনালী ব্যাংকের সভাপতি মাহবুব সোহেল বাপ্পি, সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম এবং কেন্দ্রীয় যুগ্ম আহ্বায়ক ওবায়দুর রহমানসহ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছাত্র শিবিরের বিপক্ষে কথা বলতে এখন ভীত-সন্ত্রস্ত হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির। শুক্রবার ২১ ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে এমন মন্তব্য করেন তিনি।
মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি)। শুক্রবার সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন দলটি নেতাকর্মীরা।
বাংলাদেশি বাঙালিদের জন্য এই দিবসটি হচ্ছে শোক ও বেদনার। অন্যদিকে মায়ের ভাষা বাংলা ভাষার অধিকার আদায়ের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত। ১৯৫২ সালের এদিন বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে পূর্ববাংলার (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) ছাত্র ও যুবসমাজসহ সর্বস্তরের মানুষ সে সময়ের শাসকগোষ্ঠির চোখ-রাঙ্গানি ও প্রশাসনের ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজপথে নেমে আসে। মায়ের ভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে দুর্বার গতি পাকিস্তানি শাসকদের শংকিত করে তোলায় সেদিন ছাত্র-জনতার মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে সালাম, জব্বার, শফিক, বরকত ও রফিক গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন।
জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা (ইউনেস্কো) মহান একুশের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি দেওয়ার পর থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও গত কয়েক বছর ধরে দিবসটি পালিত হচ্ছে।
একুশে ফেব্রুয়ারি সরকারি ছুটি। এদিন দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ভবনে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে সঠিক নিয়মে, সঠিক রং ও মাপে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত এবং কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়েছে। দিবসটি পালন উপলক্ষে জাতীয় অনুষ্ঠানের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনগুলো বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। আজিমপুর কবরস্থানে ফাতেহা পাঠ ও কোরানখানির আয়োজনসহ দেশের সকল মসজিদে ভাষা শহীদদের রুহের মাগফেরাত কামনায় বিশেষ দোয়া এবং উপাসনালয়ে প্রার্থনার আয়োজন করা হয়েছে।
দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন উপলক্ষে ঢাকা শহরের বিভিন্ন সড়কদ্বীপে ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সুবিধাজনক স্থানগুলোতে বাংলা ভাষার বর্ণমালা সম্বলিত ফেস্টুন দ্বারা সজ্জিত করা, বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেরিভিশন এবং অন্যান্য স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোতে একুশের বিশেষ অনুষ্ঠানমালা সম্প্রচার এবং ভাষা শহীদদের সঠিক নাম উচ্চারণ, শহীদ দিবসের ভাবগাম্ভীর্য রক্ষা, শহীদ মিনারের মর্যাদা সমুন্নত রাখা, সুশৃঙ্খলভাবে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ, ইত্যাদি জনসচেতনতা মূলক বিষয়ে সরকারি ও বেসরকারি গণমাধ্যমগুলোতে প্রয়োজনীয় প্রচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
দিবসটি উপলক্ষ্যে বিভিন্ন জাতীয় সংবাদপত্র বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছে।
জা ই / এনজি