মতামত
অর্থনৈতিক গুরুত্ব ও অবদান: কৃষি বাংলাদেশের জিডিপির প্রায় ১২-১৪ শতাংশ অবদান রাখে এবং দেশের একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী (প্রায় ৪০ শতাংশ) এই খাতে নিয়োজিত। বাজেট নির্ধারণে এই খাতের কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য বিমোচন ও খাদ্য নিরাপত্তায় অবদানের দিকগুলো গুরুত্বপূর্ণ।
খাদ্য নিরাপত্তা ও খাদ্য মজুত: খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর জন্য উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার, বীজ, সার, সেচ সুবিধা ও কৃষি গবেষণায় বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে টেকসই কৃষি চর্চায় বিনিয়োগ গুরুত্বপূর্ণ।
কৃষকের স্বার্থ সংরক্ষণ:
ভর্তুকি প্রদান: সার, ডিজেল ও কৃষি যন্ত্রপাতিতে ভর্তুকি অব্যাহত রাখা এবং সহজলভ্য করা।
কৃষিঋণ: সহজ শর্তে কৃষিঋণ প্রদান এবং ঋণগ্রস্ত কৃষকদের জন্য সহায়তা তহবিল গঠন করা। কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে বাজার ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন।
গবেষণা ও প্রযুক্তি: কৃষি গবেষণায় বাজেট বাড়ানো, বিশেষ করে জলবায়ু সহনশীল জাত উদ্ভাবনে। ডিজিটাল কৃষি তথ্যসেবা ও প্রশিক্ষণ সম্প্রসারণ।
পরিবেশবান্ধব ও টেকসই কৃষি: জৈব ও পরিবেশবান্ধব কৃষিচর্চার প্রসার। সেচে পানির অপচয় রোধ ও পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্রযুক্তির ব্যবহার উৎসাহিত করা।
বাংলাদেশের কৃষি খাতের বাজেট এমনভাবে হওয়া উচিত, যাতে কৃষকদের জীবনমান উন্নত হয়, উৎপাদনশীলতা বাড়ে এবং কৃষিকে টেকসই ও প্রযুক্তিনির্ভর খাতে রূপান্তর করা যায়।
কেমন হওয়া উচিত কৃষি খাতের বাজেট:
বাংলাদেশের কৃষি খাতের বাজেট এমনভাবে হওয়া উচিত, যাতে কৃষকদের জীবনমান উন্নত হয়, উৎপাদনশীলতা বাড়ে এবং কৃষিকে টেকসই ও প্রযুক্তিনির্ভর খাতে রূপান্তর করা যায়।
উৎপাদন খরচ কমানোর জন্য ভর্তুকি: সার, বীজ, সেচ, বিদ্যুৎ ও কৃষি যন্ত্রপাতিতে পর্যাপ্ত ভর্তুকি দিতে হবে। কৃষক যেন বাজারমূল্যের চেয়ে কম দামে এই উপকরণ পায় তা নিশ্চিত করতে হবে।
গবেষণা ও প্রযুক্তি উন্নয়ন: কৃষি গবেষণায় বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে (BRRI, BARI, BAU ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বাড়ানো)। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সহনশীল জাত উদ্ভাবনে বিনিয়োগ জরুরি।
সার্বিক কৃষি অবকাঠামো উন্নয়ন: সেচ ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন। গ্রামীণ কৃষিপণ্য পরিবহন সহজ করতে সড়ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন।
কৃষি বিপণন ও সংরক্ষণ: সংরক্ষণের জন্য হিমাগার ও সাইলোর সংখ্যা বাড়ানো। কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে সরাসরি বাজারজাতকরণ ব্যবস্থা (Digital Farmers’ Market)।
কৃষি বিমা ও নিরাপত্তা: প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জন্য কৃষি বিমা চালু ও সম্প্রসারণ। কৃষকদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি (ভাতা, সহজ ঋণ)।
যুব ও নারী কৃষকদের অন্তর্ভুক্তি: যুবদের জন্য আধুনিক কৃষিতে প্রশিক্ষণ ও উদ্যোগে বিনিয়োগ প্রণোদনা। নারী কৃষকদের জন্য আলাদা সহায়তা ও প্রযুক্তি প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা।
খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গবেষণার গুরুত্ব অনেক বেশি। বর্ধিত খাদ্য চাহিদা, জলবায়ু পরিবর্তন, কৃষি জমি হ্রাস ও উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির বাস্তবতায় টেকসই খাদ্য ব্যবস্থার জন্য গবেষণাভিত্তিক কৃষি বাজেট এখন অত্যাবশ্যক।
কৃষি খাতের বাজেটে দুর্বলতা:
বাংলাদেশের জাতীয় বাজেটে কৃষি খাতের কিছু মৌলিক দুর্বলতা রয়েছে, যা কৃষি উন্নয়ন ও কৃষকের কল্যাণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। অপর্যাপ্ত বরাদ্দ: কৃষি খাত দেশের অর্থনীতির প্রাণ হলেও বাজেটে এর জন্য বরাদ্দ মোট বাজেটের তুলনায় খুবই কম (সাধারণত ৫ শতাংশ-এর নিচে)। কৃষি GDP-র প্রায় ১২-১৩ শতাংশ অবদান রাখলেও বাজেটে অনুপাতিক বরাদ্দ দেওয়া হয় না।
প্রচলিত ও একঘেয়ে খরচ কাঠামো: বরাদ্দের বড় অংশই যায় ভর্তুকি বা চলতি খরচে (যেমন সার ভর্তুকি), উন্নয়নমূলক ও দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পে কম বরাদ্দ থাকে।
গবেষণা ও প্রযুক্তিতে বিনিয়োগের ঘাটতি: কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বরাদ্দ খুবই সীমিত, যার ফলে নতুন জাত, টেকসই প্রযুক্তি বা ক্লাইমেট-স্মার্ট কৃষিতে অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হয়।
বাজার ও প্রক্রিয়াজাতকরণে সীমিত নজর: কৃষিপণ্য বিপণন, সংরক্ষণ, হিমাগার, প্রক্রিয়াজাতকরণ ইত্যাদি খাতে বাজেট সহায়তা প্রায় অনুপস্থিত বা নগণ্য। কৃষক উৎপাদন করেও ন্যায্য মূল্য পায় না।
খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গবেষণার গুরুত্ব অনেক বেশি। বর্ধিত খাদ্য চাহিদা, জলবায়ু পরিবর্তন, কৃষি জমি হ্রাস ও উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির বাস্তবতায় টেকসই খাদ্য ব্যবস্থার জন্য গবেষণাভিত্তিক কৃষি বাজেট এখন অত্যাবশ্যক।
নারী ও ক্ষুদ্র কৃষকের জন্য বিশেষ উদ্যোগের অভাব: বাজেটে নারী কৃষক বা প্রান্তিক কৃষকদের জন্য আলাদা পরিকল্পনা ও বরাদ্দ প্রায় নেই।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় দুর্বল প্রস্তুতি: খরা, পীড়া, বন্যা বা জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবিলায় বাজেটে নির্দিষ্ট ও কার্যকর ব্যবস্থা সীমিত।
বাস্তবায়ন দুর্বলতা ও অদক্ষতা: বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও অনেক প্রকল্প সময়মতো বাস্তবায়িত হয় না। স্থানীয় পর্যায়ে কৃষকদের চাহিদা বুঝে পরিকল্পনা না করায় বাজেটের কার্যকারিতা কমে যায়। রপ্তানি সক্ষমতা অত্যন্ত দুর্বল, কৃষিপণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা করতে অনেকটাই অপারগ।
উন্নত দেশে কৃষি খাতের বাজেটের অভিজ্ঞতা:
উন্নত দেশগুলোতে (যেমন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ইত্যাদি) কৃষি বাজেটের কিছু স্পষ্ট সবল দিক রয়েছে, যা কৃষিখাতকে আধুনিক, টেকসই এবং লাভজনক খাতে পরিণত করেছে।
সবল দিকসমূহ:
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক কৃষিতে বিনিয়োগ: গবেষণা ও উদ্ভাবনে বড় অংকের বরাদ্দ (R&D বাজেট বেশি)। অটোমেশন, ড্রোন, AI, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদি প্রযুক্তি ব্যবহারে সহায়তা।
চাষিদের জন্য কৃষি বিমা ও আর্থিক নিরাপত্তা: আবহাওয়া বা বাজারভিত্তিক ঝুঁকি মোকাবেলায় কৃষকদের জন্য ফসল বিমা ও ক্ষতিপূরণ সিস্টেম। কৃষকদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ ও সাবসিডি।
দক্ষ কৃষি অবকাঠামো ও সরবরাহ ব্যবস্থা: উন্নত সেচ, সংরক্ষণ, পরিবহন, ও সরাসরি বাজারজাতকরণ ব্যবস্থায় বড় বিনিয়োগ। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারি খাদ্য গুদাম ও প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র।
প্রশিক্ষণ ও কৃষি শিক্ষায় বাজেট বরাদ্দ: কৃষকদের জন্য আধুনিক প্রশিক্ষণ কর্মসূচি। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে বাজেট।
পরিবেশবান্ধব ও টেকসই কৃষিতে উৎসাহ: জৈব চাষ, পানি সাশ্রয়ী প্রযুক্তি, এবং জলবায়ু সহনশীল চাষ পদ্ধতিতে প্রণোদনা।
ডিজিটাল কৃষি: কৃষকদের জন্য ডিজিটাল অ্যাপ, তথ্য প্ল্যাটফর্ম ও বাজার ব্যবস্থাপনা সিস্টেম।
সুফলসমূহ:
উচ্চ উৎপাদনশীলতা: কম জমিতেও বেশি ফলন (precision farming)।
রপ্তানি সক্ষমতা: কৃষিপণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা করতে পারে।
কৃষকের আয় বৃদ্ধি: স্থিতিশীল আয় ও উচ্চ জীবনমান।
ঝুঁকি হ্রাস: প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা বাজার ওঠানামা সত্ত্বেও কৃষক সুরক্ষিত।
পরিবেশ রক্ষা: টেকসই ও কার্বন হ্রাসকৃত কৃষি ব্যবস্থা।
তরুণদের অংশগ্রহণ: প্রযুক্তিনির্ভর কৃষির কারণে যুবসমাজ আকৃষ্ট হচ্ছে।
লেখক : কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ
srb_ccdbseed@yahoo.com
জা ই / এনজি ডেস্ক