রাত ৯:২৯ | বুধবার | ৩০শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১৭ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, গ্রীষ্মকাল | ১লা জিলকদ, ১৪৪৬ হিজরি

আ’লীগ সরকারের ব্যাপক দূর্নীতি অব্যবস্থাপনায় গ্যাস সংকট চরমে

গোলাম মাওলা শিমুল

১৬ অক্টোবর ২০২৪

 

গত আওয়ামী সরকারের ব্যাপক লুটপাট আর অব্যবস্থাপনার কারণে দেশে গ্যাস সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। নানা প্রকল্পের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট, গ্যাস খাতের নানা দুর্নীতি-অনিয়ম নিয়ে বিভিন্ন সময় ব্যাপক সমালোচনা হলেও তা দূর করার চেষ্টা কখনোই করা হয়নি। বরং সরকারি ও রাজনৈতিকভাবে এসব অপতৎপরতা আরও গতিশীল করা হয়েছে। ফলে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা এই খাতটির ভয়াবহ ভরাডুবি ঘটেছে। ১৬ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন তহবিলের টাকা দিয়েও গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের কাজ করার সুযোগ থাকলেও তা করা হয়নি। বরং গ্যাস উন্নয়ন তহবিলের অনিয়মের মাধ্যমে ভিন্ন খাতে ব্যবহার করা হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন,গ্যাসের অভাবে এরইমধ্যে চাপে ভুগছে শিল্প, বিদ্যুৎ ও সার উৎপাদন। অন্তর্বর্তী সরকার নানান চ্যালেঞ্জ ও সংস্কার নিয়ে আলোচনা করলেও তার ফাঁকে গ্যাসের বিষয়টি অনেকটা আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সংকট সমাধানে অন্তর্বর্তী সরকারকে দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে। গ্যাস অনুসন্ধানে মনোযোগ দিতে হবে। পাশাপাশি এই খাত থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটের বিষয়টিও আমলে নিতে হবে। স্বৈরাচার শেখ হাসিনার সরকার গত সাড়ে ১৫ বছরে গ্যাস খাতে ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি লুটপাট করেছে বলে জানা গেছে।

দেশে গ্যাসের তীব্র সংকটের বিষয়টি স্বীকার করেছেন জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। তিনি বলেন, দেশে গ্যাসের তীব্র সংকট চলছে। আমাদের ৪ হাজার এমসি গ্যাস দরকার। সেখানে আমরা ৩ হাজার এমসি গ্যাস পাচ্ছি। তিনি বলেন, প্রয়োজনে আমাদের গ্যাস আমদানি করতে হচ্ছে। এ জন্য প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রার ব্যয় হয়। অনেকেই বলছেন, আমরা বাসাবাড়িতে গ্যাস দেব, এটা আসলে সঠিক খবর নয়। তবে ভবিষ্যতে গ্যাস সরবরাহ বাড়লে তখন এ বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করা হবে। সম্ভাবনার ও সমস্যার কথা বলতেই তিনি টেনে আনেন দুনীৃতি লুটপাটের বিষয়টিও। উপদেষ্টা বলেন, দেশে লুটপাট হয়েছে, এটা সবাই জানেন। এর থেকে বাদ যায়নি জ¦ালানি খাতও। তিনি বলেন, এই সরকারের মেয়াদ বেশি দিনের নয়। দীর্ঘ দিনের সংকট সমাধানে সময় লাগবে। আমরা গ্যঅস সংকট সমাধানের উদ্যোগ নিচ্ছি। আশা করি দ্রুতই সুফল পাওয়া যাবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের স্থলভাগে ও সমুদ্রে পর্যাপ্ত গ্যাস থাকলেও তা অনুসন্ধান উত্তোলনে গত আওয়ামী সরকার কার্যকর ভূমিকা না নিয়ে দলীয় ব্যবসায়ী ও কমিশনভোগীদের স্বার্থে এই খাতকে আমদানিনির্ভর খাতে পরিণত করা হয়েছে। বারবার গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। গ্যাস বিল দেওয়ার সময় সাধারণ জনগণের টাকায় গ্যাস উন্নয়ন তহবিল গঠন করা হয়েছিল। গত ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত এই তহবিলে মজার পরিমাণ দাঁড়ায় ১৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। ওই উন্নয়ন তহবিলের টাকা দিয়েও গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের কাজ করার সুযোগ থাকলেও তা করা হয়নি। বরং গ্যাস উন্নয়ন তহবিলের টাকা গ্যাস আমদানিতে ব্যবহার করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, সংকট কাটাতে দেশি গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদন বাড়ানোর ওপর জোর দেয়া প্রয়োজন। বিগত সরকার নতুন নতুন কূপ খননের পরিকল্পনা নিলেও নানা অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নেও পিছিয়েছে সরকারি সংস্থাগুলো। গ্যাস উত্তোলন বাড়াতে চার বছরে ৪৬টি কূপ লক্ষ্য ঠিক করেছিল। এর মধ্যে ২০২২ ও ২০২৩ সালের মধ্যে ২১টি কূপ খননের কথা। যদিও হয়েছে মাত্র ৯টি। একই সময়ের মধ্যে নতুন কূপ থেকে জাতীয় গ্রিডে দিনে ২৮ কোটি ঘনফুট গ্যাস যুক্ত হওয়ার কথা। হয়েছে মাত্র আড়াই কোটি ঘনফুট, যা লক্ষ্যমাত্রার ৯ শতাংশ।

স্থলভাগে গ্যাসকূপ খননের যখন এই অবস্থা, তখন সমুদ্রে আরও পিছিয়ে ছিল গত সরকার। পেট্রোবাংলা বলছে, সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির এক যুগ পরও বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে তেমন গতি নেই। অথচ মায়ানমার ও ভারত বাংলাদেশে সমুদ্র সীমা গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন করছে।
জানা গেছে, গ্যাস সংকটের কারণে শিল্পে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। বর্তমানে উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে। বিভিন্ন গার্মেন্টস মালিকরা বায়ারদের নির্ধারিত সময়ে শিপমেন্ট করতে না পেরে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এতে করে শ্রমিকদের বেতন ভাতা পরিশোধ নিয়ে চরম বিপাকে রয়েছেন শিল্পমালিকরা। মালিকরা আশঙ্কা করছেন, সংকট অব্যাহত থাকলে লোকসানের কবলে পড়ে বন্ধ হয়ে যেতে পারে অনেক প্রতিষ্ঠান।
তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ’র সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বর্তমানে গ্যাস বিদ্যুৎ নিয়ে চরম সংকটে রয়েছি। বিগত সরকারের আমলে যখন গ্যাসের দাম অস্বাভাবিকহারে বৃদ্ধি করা হলো তখন কথা ছিল আমাদেরকে আনইন্টারেপ্টেড পর্যাপ্ত গ্যাস দিবে। এজন্যই অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছিল। কিন্তু সত্য হলো আমরা বর্ধিত দামেও পর্যাপ্ত গ্যাস পাইনি। বর্তমানে কোন কোন এলাকায় তো গ্যাস একেবারেই পাওয়া যাচ্ছে না। বর্তমান সরকারকে আমরা বলেছি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এসব সমস্যার সমাধান করতে।

জানা গেছে, দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদন বাড়ানো যাচ্ছে না। আড়াই মাস ধরে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) সরবরাহ হচ্ছে সক্ষমতার অর্ধেক। আগামী এক মাসেও এলএনজি সরবরাহ বাড়বে না। ফলে শিগগিরই কাটছে না চলমান গ্যাস-সংকট। বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) বলছে, দীর্ঘদিন ধরে গ্যাস খাত চলছে রেশনিং (এক খাতে সরবরাহ কমিয়ে অন্য খাতে দেওয়া) করে। তারা জানায়, দেশে দিনে গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে ৩০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হয়। কোনো কারণে সরবরাহ এর চেয়ে কমলেই বেড়ে যায় সংকট। এখন সরবরাহ হচ্ছে ২৬০ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে দিনে এখন উৎপাদন হচ্ছে ২০০ কোটি ঘনফুট। বাকিটা নেওয়া হয় এলএনজি থেকে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্যাস-সংকটে পড়েছে শিল্প, আবাসিক ও বিদ্যুৎ খাত। বিদ্যুৎ খাতে দিনে গ্যাসের চাহিদা ২৩০ কোটি ঘনফুট। সর্বোচ্চ চাহিদার সময় ১৫০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ চায় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। যদিও তারা সর্বোচ্চ সরবরাহ পেত দিনে ১৩০ কোটি ঘনফুট। এখন সরবরাহ করা হচ্ছে ৯০ কোটি ঘনফুট। এতে প্রায় দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে গেছে। তাই লোডশেডিং হচ্ছে। সার শিল্পে দৈনিক চাহিদা হচ্ছে ৩২৯ মিলিয়ন ঘনফুট আর সরবরাহ করা হচ্ছে ১৬০ দশমিক ১ মিলিয়ন ঘনফুট। এমনি ভাবে প্রতিটি খাতেই চাহিদার তুলনায় প্রায় অর্ধেক গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে।গ্যাসের সরবরাহ কমায় রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় রান্নার চুলা জ্বালাতে হিমশিম খাচ্ছেন গ্রাহকেরা। গ্যাসের অভাবে বন্ধ আছে তিনটি ইউরিয়া উৎপাদনের সার কারখানা। বছরের বেশির ভাগ সময়ই কোনো না কোনো সার কারখানা বন্ধ রাখতে হয়।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, গাজীপুরের বেশির ভাগ এলাকায় কয়েক বছর ধরেই গ্যাস-সংকট ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। নগরের বাসন, ভোগাড় কোনাবাড়ী, ভবানীপুর, কালিয়াকৈর, কাশিমপুর ও এর আশপাশের এলাকার বেশির ভাগ কারখানায় গ্যাস-সংকটের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। তিতাসের গাজীপুর শাখা ব্যবস্থাপক (ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশন) মো. রেদওয়ান বলেন, গাজীপুরে দিনে গ্যাসের চাহিদা প্রায় ৬০ কোটি ঘনফুট। সরবরাহ হচ্ছে ৪০ কোটি ঘনফুট। নারায়ণগঞ্জে বন্দর উপজেলার লাঙ্গলবন্দ এলাকায় অবস্থিত রপ্তানিমুখী টোটাল ফ্যাশন লিমিটেডে প্রতিদিন উৎপাদন ক্ষমতা ১০ টন। কিন্তু গ্যাস-সংকটের কারণে কারখানার উৎপাদন বন্ধ রয়েছে।

সূত্র মতে, শেখ হাসিনা সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে গ্যাস খাতে নানামুখী অনিয়ম-দুর্নীতি ও চুরি সংঘটিত হয়েছে। এর মধ্যে দাম দিয়ে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) কেনার পর শুধু চুরি ও অপচয়েই বছরে ক্ষতি হয়েছে ১০০ কোটি ডলার (১২ হাজার কোটি টাকা)। অন্যান্য খাত মিলিয়ে সর্বমোট লোকসানের পরিমাণ এর অন্তত ১০ গুণ বলে সংশ্লিষ্টরা নিশ্চিত করেছেন। গ্যাস খাতের নানা দুর্নীতি-অনিয়ম নিয়ে বিভিন্ন সময় ব্যাপক সমালোচনা হলেও তা দূর করার চেষ্টা কখনোই করা হয়নি। বরং সরকারি ও রাজনৈতিকভাবে এসব অপতৎপরতা আরও গতিশীল করা হয়েছে। ফলে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা এই খাতটির ভয়াবহ ভরাডুবি ঘটেছে।

পেট্রোবাংলার দেওয়া সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী ৯ সেপ্টেম্বর বিজিএফসিএল’র আওতাধীন তিতাসের ২৬টি কূপের ক্যাপাসিটি ৫৪২ মিলিয়ন ঘনফুট হলেও এদিন উৎপাদন ছিল ৩৭৭ মিলিয়ন ঘনফুট। হবিগঞ্জের ৮টি কূপের ক্যাপাসিটি ২২৫ মিলিয়ন ঘনফুট হলেও উৎপাদন ছিল ১১৬.১ মিলিয়ন ঘনফুট। এ ছাড়া বিবিয়ানার ১২০০ মিলিয়ন ঘনফুট ক্যাপাসিটি ২৬টি কূপের উৎপাদন ছিল ১০০৬.৮ মিলিয়ন ঘনফুট। সব মিলিয়ে ১১৬টি কূপের মোট ক্ষমতা ৩ হাজার ৮২৯ মিলিয়ন ঘনফুট হলেও ৯ সেপ্টেম্বর গ্যাস উৎপাদন হয়েছে মাত্র ২ হাজার ৬০৯ দশমিক ৪ মিলিয়ন ঘনফুট। এই হিসাবে সক্ষমতা অনুযায়ী, গ্যাস পাওয়া গেছে মাত্র ৬৮.১৩ শতাংশ।

জানা যায়, গ্যাস খাতে গড়ে কারিগরি ক্ষতি (সিস্টেম লস) দেখানো হয়েছে ১০ শতাংশ। গ্যাস সরবরাহে অপচয়ের পাশাপাশি চুরিও হয়। শিল্পেও চুরির গ্যাস ব্যবহার করে। তবে সবচেয়ে বেশি চুরি হয় আবাসিক খাতে। অথচ ৫ শতাংশ চুরি কমিয়ে শিল্পে সরবরাহ করা হলে চলমান গ্যাস সংকট কাটানো সম্ভব হতো। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম. তামিম ইকবল বলেন, আন্তর্জাতিকভাবে গ্যাস খাতে ২ থেকে ৩ শতাংশ অপচয় মানা হয়। বাংলাদেশের জন্য এটি বড়জোর ৫ শতাংশ হতে পারে। অথচ বছরের পর বছর সিস্টেম লস এর দ্বিগুণ দেখানো হচ্ছে। যা মূলত অর্ধেকই চুরি। সরকারি ও রাজনৈতিক সিন্ডিকেট এর ফয়দা লুটেছে।

 

শিমুল / এনজি

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *